ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই, ২০২৫

কোটা নেই, কোটা আছে 

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০২৫, ০১:৪৫ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলন রূপ নিয়েছিল রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে। সরকারি হিসাবেই এই অভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছে ৮৩৪ জন ছাত্র-জনতা। আন্দোলনে তোপের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশে এত বড় আন্দোলন হয়েছিল, সেই কোটাপ্রথা কতটা বাতিল হলো সেই প্রশ্ন এখন সবার মাঝে। 

সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, যারা কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন তারা এখন পাচ্ছেন নানাভাবে কোটা সুবিধা বা সরকারের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। হতাহতদের ঢালাওভাবে এই সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জুলাইয়ে হতাহতদের মধ্যে যাদের প্রকৃত সহযোগিতা করা দরকার শুধু তাদেরই সহযোগিতা করা উচিত। গণহারে এই স্বীকৃতি দিয়ে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় হিতে বিপরীত হতে পারে। ভুয়া জুলাইযোদ্ধারা এই সনদ ও সুবিধা নিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মতো নানা অনৈতিক কাণ্ড করার শঙ্কা রয়েছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থার চালু করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের সচিবের এক নির্বাহী আদেশে তা কার্যকর হয়। এরপর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অনগ্রসর, পোষ্যসহ নানা কোটা প্রথা বিদ্যমান ছিল। এই কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে দেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশাল আন্দোলন। সেই আন্দোলনের পর কোটা প্রথা বাতিল করে আদালত। 
এরপর ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই কোটা সংস্কারে দাবিতে ফের আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

ওই সময় শিক্ষার্থীদের চার দফা দাবির মধ্যে ছিল ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিয়ে কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রাখা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করা। 

সেই আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে তা দমাতে আওয়ামী লীগ সরকার নানাভাবে বল প্রয়োগ শুরু করে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যোগ দেন দেশের নানা পেশার মানুষ। শেষমেশ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জুলাই আন্দোলনে নিহতদের ‘জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ’ এবং আহতদের ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করে অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার এবং জুলাইযোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে সরকার। এতে নিহত ৮৩৪ জনের এবং তিন ক্যাটাগরিতে আহত ১২ হাজার ৪৩ জনকে গেজেটভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ‘অতি গুরুতর আহত’দের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, যার মোট সংখ্যা ৪৯৩। এ ছাড়া ৯০৮ জন ‘গুরুতর আহত’কে ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত এবং ১০ হাজার ৬৪২ জনকে ‘আহত’কে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও তাদের পুনর্বাসনের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর নামে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি অধিদপ্তর করেছে সরকার।

সরকারি তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত জুলাই আন্দোলনে আহত-নিহতদের পুনর্বাসনের জন্য যেসব উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে নিহতদের পরিবার ও আহতদের এককালীন ও মাসিক ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ, সরকারি হাসপাতালে আহতদের আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা সুবিধা, সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে আহত ও নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যদের অগ্রাধিকার, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের জন্যে সহজ শর্তে ঋণ বা অনুরূপ সুবিধা দেওয়া, আন্দোলনে আহতদের জন্য ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কর ছাড়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা অন্যতম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জুলাই যোদ্ধাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং গুরুতর আহতদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। তাদের এককালীন অর্থ, মাসিক সম্মানী, চিকিৎসা ভাতা, বাসস্থানের ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান করতে সরকার এখন পর্যন্ত ৬৩৫ কোটিরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

এ ছাড়াও গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বরাদ্দ ৫ শতাংশ কোটার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পরিবারের সদস্যদের যুক্ত করে এক আদেশ জারি করা হয়। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই আদেশ বাতিল করে কেবল ২০২৫ সালের জন্য নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়।

মক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের জন্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা এককালীন ভাতা এবং ২০ হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহতরা যথাক্রমে এককালীন পাঁচ লাখ, তিন লাখ এবং এক লাখ টাকা আর মাসিক ২০ হাজার, ১৫ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন। চলতি মাস থেকেই তারা এই মাসিক ভাতা পাবেন বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। 

এদিকে জুলাইযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই গেজেটে অনেকেই তালিকাভুক্ত হয়েছেন যারা জুলাই আন্দোলনে অংশ নেননি। কেউ কেউ জুলাই আন্দোলনে হামলা করতে এসেছিলেন আবার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেকেও জুলাইযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেনÑ এমন খবর এসেছে রূপালী বাংলাদেশসহ অনেক গণমাধ্যমে। জুলাইযোদ্ধাদের অনেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। 

অন্যদিকে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হলেও ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পোষ্য কোটাসহ ১১ ধরনের কোটা রয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, খেলোয়াড়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অ-উপজাতি (পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালি), বিদেশি শিক্ষার্থী, দলিত, চা-শ্রমিক, বিকেএসপি (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ও উপাচার্য কোটায় তাদের স্বজনরা পাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিসহ নানা সুবিধা। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘গেজেটভুক্তরা মাসিক ভাতার পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধারা আজীবন সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতালগুলোতে বিনা খরচে চিকিৎসা পাবেন। এছাড়াও শহিদ পরিবারের সক্ষম সদস্যরা অগ্রাধিকার পাবেন সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিতে।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুগ্ম আহ্বায়ক ও বর্তমানে যুব অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক মনজুর মোরশেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় ৫ আগস্টের পর জুলাই আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তারা নিয়োগ-বদিল, বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতে জড়িয়েছে। এটা নিয়ে আমরা বিব্রত। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের হয়তো আরেকটা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কোটা সংস্কারের জন্যই আন্দোলন হয়েছিল সুতরাং ব্যাপকভাবে কোটা ফিরে আসা অবশ্যই কাম্য এবং যৌক্তিক নয়। সংবিধানের ২৯ অনুসারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখাটা অবশ্যই যৌক্তিক। এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ যারা স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য রাখে না সব মিলিয়ে কোটা বা বিশেষ সুবিধা ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের বেশি রাখা উচিত নয়। মেধাবীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।