নিবন্ধনের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিবেচনায় এসেছে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। নিবন্ধনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলটি নির্বাচন কমিশনে ‘শাপলা’ প্রতীক বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করে। তবে ইসি জানিয়েছে, ‘শাপলা’ প্রতীকটি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার তালিকায় না থাকায় এটি কোনো রাজনৈতিক দলকে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়।
এর প্রেক্ষিতে কমিশন এনসিপিকে তাদের তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীকের মধ্য থেকে যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার অনুরোধ করেছে। নির্ধারিত সময়সীমা হিসেবে আগামী মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর)-এর মধ্যে প্রতীক চূড়ান্ত করার জন্য বলা হয়েছে।
এদিকে কমিশনের দেওয়া কিছু প্রতীক, যেমন: আলমিরা, উটপাখি, কাপ-পিরিচ ও থালাবাটিকে ‘হাস্যকর’ আখ্যা দিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কীভাবে প্রতীক আদায় করতে হয়, তা আমরা জানি।’
অন্যদিকে এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম শাপলা প্রতীক না পেলে নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়েছেন।
তবে এসব হুমকি-ধমকির মধ্যেও নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। ইসি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘শাপলা’ প্রতীকটি যেহেতু তালিকাভুক্ত নয়, তাই এটি এনসিপি হোক বা অন্য কোনো দল—কাউকেই বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই।
শাপলায় এনসিপির আগ্রহ কেন?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য গত জুন মাসে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করে। নিবন্ধনের আবেদনের পাশাপাশি তারা দলের প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ চায়।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘শাপলা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। মানুষ সহজেই শাপলার সঙ্গে নিজেদের মানসিকভাবে সংযুক্ত করতে পারে। এ বছরের জুলাই পদযাত্রার সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাপলা প্রতীকের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন দেখা গেছে।’
তবে এনসিপির এই দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কারণ নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৯(১) অনুযায়ী, শাপলা প্রতীকটি নিবন্ধনযোগ্য প্রতীকের তালিকায় নেই। এর অন্যতম কারণ, শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, যা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি নেই বলে সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশ মনে করে।
বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক হইতেছে উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষবেষ্টিত, পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত পত্র, তাহার উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া তারকা।
এনসিপি দাবি করেছে, তারা সময়মতো ইসিকে দুইবার চিঠি দিয়ে শাপলা প্রতীকের আবেদন করলেও সেসব চিঠির কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব পায়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। কিন্তু ইসি আমাদের আগের দুটি আবেদন নিষ্পত্তি না করেই হঠাৎ করে একটি চিঠি দিয়েছে, যা আমরা আইনসংগত মনে করি না। এটি একটি কৌশলী পদক্ষেপ। ইসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমন আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত। তাদের উচিত ছিল আগের আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া।’
তিনি আরও জানান, ‘আমরা অবশ্যই চিঠির উত্তর দেব। আর শাপলা প্রতীক ইস্যুটি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার চিন্তা করছি।’
দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি এবং প্রচার ও প্রকাশনা সেলের সদস্য খালেদ সাইফুল্লাহ জুয়েলের মতে, ‘কলম বা মোবাইল ফোন প্রতীকের চেয়ে শাপলা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। শাপলাকে আলাদা করে চেনাতে হয় না, এটি সবার মনোজগতে আগেই গেঁথে আছে। এমন একটি প্রতীক পেলে দলের প্রচার-প্রচারণা সহজ হবে।’
উল্লেখ্য, শাপলা প্রতীক পেতে ফাইট করবেন বলেও মতামত প্রকাশ করেছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, ‘শাপলার জন্যই আমরা ফাইট করব। আইনগত কিংবা রাজনৈতিক যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় আমরা নেব।’
শাপলার বিকল্প ভাবছে এনসিপি?
এদিকে শাপলা প্রতীক পাওয়ার দাবিতে অনড় রয়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (এনসিপি)। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিষ্ক্রিয়তা ও আপত্তির মুখে দলটি এখন বিকল্প প্রতীক নিয়েও ভাবতে শুরু করেছে। যদিও তারা স্পষ্ট করেছে, শাপলা প্রতীক না পাওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক ও আইনগত লড়াই চালিয়ে যাবে।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী মনে করেন, ‘শাপলা প্রতীক পেতে তাদের কোনো আইনি বাধা নেই। নির্বাচন কমিশনেরও এতে কোনো ধরনের চাপ অনুভব করার কথা নয়।’
প্রতীক পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি অভিযোগ করে আরও জানিয়েছন, ‘অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় প্রতীক বা তার উপাদান ব্যবহার করলেও এনসিপির ক্ষেত্রে শুধু বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে।’
দলের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। দলটি বলছে, শাপলা প্রতীক পেতে তাদের আইনি অবস্থান দৃঢ় এবং ইসি চাইলে অনায়াসেই প্রতীকটি বরাদ্দ দিতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের রাজনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে দলটি।
যদিও শাপলার প্রতি অনড় অবস্থান বজায় রেখেছে এনসিপি, তথাপি শেষ পর্যন্ত প্রতীকটি না পেলে বিকল্প চিন্তাও করছে তারা। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরা হুবহু শাপলা থেকেও কিছুটা সরে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বলেছি, অন্তত সাদা শাপলা বা লাল শাপলা হলেও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ইসি সেটা বিবেচনাও করছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আগেই আমাদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয়তে রেখেছিলাম কলম এবং তৃতীয়তে মোবাইল ফোন। প্রয়োজনে বিকল্প প্রতীক নিয়েও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তবে দলীয় ফোরামেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এদিকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাও জানিয়েছেন, ‘এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়া হলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি থাকবে না।’ একই মত পোষণ করেছেন একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ, যারা মনে করেন, শাপলা প্রতীক দিতে ইসির আইনগত কোনো বাধা নেই।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন