শনিবার, ০৭ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২৫, ০৬:৩২ পিএম

কোরবানি ও সামাজিক সাম্য: ইসলাম কী শিক্ষা দেয়?

মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২৫, ০৬:৩২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ইসলামে কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা ঈদুল আযহার অন্যতম মূল ভিত্তি। এর শাব্দিক অর্থ ‘ত্যাগ করা’, আর ধর্মীয় পরিভাষায় কোরবানি বলতে বোঝায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট প্রকার পশু জবাই করা।

কিন্তু এই ইবাদত শুধু পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর ভেতরে নিহিত রয়েছে মানবিকতা, আত্মত্যাগ, সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অমূল্য শিক্ষা।

ইসলাম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উপাসনার ধর্ম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা সামাজিক দায়বদ্ধতা, সহানুভূতি, এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।

কোরবানির মাধ্যমে ইসলাম আমাদের শেখায় একটি সমাজকে একসাথে এগিয়ে নিতে হলে ধনী-গরীবের মাঝে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সাম্য থাকা জরুরি।

বর্তমান সমাজে ধনসম্পদের অসাম্য, ভোগ-বিলাসের প্রতিযোগিতা এবং গরীবদের প্রতি অবহেলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কুরবানীর শিক্ষা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

কারণ, কোরবানি হচ্ছে সেই ইবাদত, যেখানে ধনী তার সম্পদ দ্বারা গরীবের পাশে দাঁড়ায় এবং সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার বাস্তব উদাহরণ তৈরি হয়।

কোরবানির পেছনে আত্মিক শিক্ষা

কোরবানির আড়ালে শুধুই পশু জবাই নয়, বরং রয়েছে একজন মুমিনের আত্মিক পরিশুদ্ধির গভীর আহ্বান। কুরআনে বলা হয়েছে:

"এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।"
(সূরা হজ্জ, আয়াত ৩৭)

এই আয়াত প্রমাণ করে যে, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য পশু জবাই নয়, বরং নিজের আত্মা ও চরিত্রকে শুদ্ধ করা। এই ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য, ভক্তি ও খোদাভীতিকে প্রমাণ করে। এটি তাকওয়ার চর্চা ও অন্তরের পরিশুদ্ধির একটি মাধ্যম।

একইসঙ্গে, কোরবানি আমাদের আত্মত্যাগের শিক্ষাও দেয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর আদেশে কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

এই ঘটনা আমাদের শেখায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটিও ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা উচিত।

সুতরাং, কোরবানি আমাদের আত্মাকে নির্মল ও আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী করে তোলে, যা ব্যক্তিগত নৈতিকতা এবং সামাজিক ন্যায়বোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কোরবানি এবং সামাজিক সাম্যের সম্পর্ক

কোরবানি ইসলামের একটি এমন ইবাদত, যা ব্যক্তিগত তাকওয়ার পাশাপাশি সামাজিক সাম্যের মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলে। এই ইবাদতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্র একত্রিত হয় একটি মানবিক বন্ধনে, যেখানে সকলের মধ্যে ভাগাভাগির চর্চা হয়।

ধনী ব্যক্তি যখন তার কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয়ে পশু কিনে, এবং সেই পশুর মাংস গরীব-দুস্থদের মাঝে বণ্টন করে, তখন সেখানে গড়ে ওঠে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা।

ইসলাম স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, কোরবানির গোশতের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে:

"তারা যেন তা খায় এবং অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রকে খাওয়ায়"
(সূরা হজ্জ, আয়াত ২৮)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কোরবানি শুধু একটি ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি মাধ্যম। এমনকি যারা কোরবানি দিতে সক্ষম নয়, তারাও যেন অন্ততপক্ষে অন্যের কুরবানী থেকে কিছুটা উপকৃত হতে পারে এই শিক্ষাই ইসলাম দেয়। এটি মুসলিম সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির বাস্তব উদাহরণ।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনে কোরবানি ও মানবিকতা

রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানির মাধ্যমে মানবিকতা ও সাম্যের বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি কখনো কোরবানিকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে গ্রহণ করেননি; বরং এটিকে দরিদ্র ও নিঃস্বদের মুখে হাসি ফোটানোর একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

রাসূল (সা.) কোরবানির গোশত নিজে খান, আত্মীয়-স্বজনদের দেন এবং সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন দরিদ্র ও অভাবীদের। হাদীসে এসেছে:

“কোরবানির গোশত তিনভাগে ভাগ করো: একভাগ নিজের জন্য, একভাগ আত্মীয়দের জন্য, একভাগ গরীবদের জন্য।”
(মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা)

এছাড়া, তিনি কখনোই লোক দেখানোর জন্য বড় পশু কোরবানি দিতেন না বরং উদারতায় ও আন্তরিকতায় অগ্রাধিকার দিতেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও এই শিক্ষা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

তারা কোরবানির দিনে গোশত বিতরণ করাকে ইবাদতের অন্যতম অঙ্গ মনে করতেন। এই উদাহরণগুলো আমাদের শেখায় কোরবানি শুধু রক্ত ঝরানো নয়, বরং মানবতার অঙ্গীকার।

কোরবানির মাধ্যমে অহংকার ও বৈষম্য দূরীকরণ

ইসলাম এমন কোনো কাজকে উৎসাহিত করে না, যা মানুষের মধ্যে অহংকার, রিয়া (লোক দেখানো) কিংবা সামাজিক বৈষম্য তৈরি করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমান সময়ে অনেকেই কোরবানিকে একটি ‘প্রদর্শনীর’ মত করে তুলেছে কে কত বড় ও দামি পশু জবাই করতে পারে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। এটি কোরবানির মূল উদ্দেশ্য ও আত্মিক শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি।

কুরআন স্পষ্ট করে বলেছে:

"আল্লাহর কাছে তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।"
(সূরা হজ্জ, আয়াত ৩৭)

এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কোরবানির মূল হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি, রিয়া বা সমাজে নিজের অবস্থান প্রমাণ নয়। দামি পশু কিনে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা, মানুষকে ঈর্ষান্বিত করা কিংবা গরীবদের অবহেলা করা এসব আচরণ ইসলামের চেতনাবিরোধী।

তাই কোরবানি আমাদের অহংকার নয়, নম্রতা শেখায়। এটি আমাদের শেখায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের কল্যাণই হলো ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য। এমনকি গরীব-অসহায় মানুষদের কাছে কুরবানীর একটি টুকরো গোশতও যে কত আনন্দ বয়ে আনে তা উপলব্ধি করাটাই কুরবানীর প্রকৃত রুহ।

দরিদ্রদের মাঝে কুরবানীর বণ্টনের শিক্ষা

কোরবানি শুধু আত্মিক পবিত্রতার মাধ্যম নয়, এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রকাশও। ইসলামে কোরবানির গোশত বণ্টনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। এটি সমাজের সেই মানুষদের মুখে হাসি ফোটায়, যারা হয়তো বছরের বেশিরভাগ সময় পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত থাকে।

কুরবানীর দিনে গোটা মুসলিম উম্মাহ একসাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়, ধনী ও গরীবের মাঝে দূরত্ব কমে আসে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই কোরবানির গোশত বিতরণ করতেন এবং সাহাবাগণকেও এই কাজে উৎসাহ দিতেন। হাদীসে এসেছে:

"তারা যেন তা নিজেরাও খায় এবং মিসকীন ও ফকীরদের খাওয়ায়।"
(সূরা হজ্জ: ২৮)

এ শিক্ষা আমাদের বলে যে কোরবানি অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না, সে কুরবানী আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ নয়। সুতরাং, গোশত কেবল আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দরিদ্রদের মাঝে যথাযথভাবে বিতরণ করাই কোরবানির প্রকৃত রূহানিয়াত।

ঈদুল আযহা ও মুসলিম মিলনমেলা

কোরবানির ঈদ মানেই মুসলমানদের জন্য একটি মহামিলন ও ঐক্যের প্রতীক। এই দিনে প্রত্যেক মুসলিম একসাথে নামাজে অংশগ্রহণ করে, একে অপরকে আলিঙ্গন করে, কুশল বিনিময় করে যা সমাজে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে।

কুরবানীর মাধ্যমে এই বন্ধন আরও দৃঢ় হয়, যখন সবাই মিলে কুরবানীর কাজে অংশগ্রহণ করে, একে অপরকে সাহায্য করে এবং মাংস ভাগাভাগি করে।

এই ঈদের তাৎপর্য শুধু আনুষ্ঠানিকতায় নয়, বরং একজন মুসলিমের মনে সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ ও ঐক্যের চেতনা জাগিয়ে তোলে। ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, রাজা-প্রজা সবাই একই কাতারে নামাজ আদায় করে, যা ইসলামের সামাজিক সাম্যের বাস্তব উদাহরণ।

তাই ঈদুল আযহা শুধুমাত্র আনন্দের দিন নয়, এটি হলো মুসলিম সমাজের জন্য একটি মূল্যবান সুযোগ ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি ও একতার বন্ধন দৃঢ় করার।

কোরবানি ইসলামের এক মহান ইবাদত, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে আত্মত্যাগ, তাকওয়া, সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার অমূল্য শিক্ষা। এটি শুধু একদিনের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি চেতনার নাম যা ধনীর অন্তরে নম্রতা আনে, গরীবের মুখে হাসি ফোটায় এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।

বর্তমান সময়ে আমাদের কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবন করে তা ব্যক্তি জীবনে ও সমাজে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অহংকার, প্রদর্শন, বৈষম্য কিংবা লোক দেখানোর পরিবর্তে আসুন আমরা তাকওয়া, সহানুভূতি ও সমবেদনার উপর ভিত্তি করে কুরবানী পালন করি।

এইভাবেই কুরবানী আমাদের সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, মানবিক ও আল্লাহভীতিসম্পন্ন পরিবেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই শিক্ষাগুলো বাস্তব জীবনে বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন, আমিন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!