ইসলামের মহান নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন শুধুমাত্র মুসলিম বিশ্বের জন্য নয়, সমসাময়িক ইহুদি পণ্ডিতদের মধ্যেও ছিল একটি অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক পূর্বাভাসের বিষয়। নবীর জন্মকালীন এবং পরবর্তী সময়ে মক্কা ও মদিনার ইহুদি পণ্ডিতদের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণী, ধর্মগ্রন্থভিত্তিক প্রত্যাশা এবং জন্মকালীন অলৌকিক ঘটনাগুলো ইসলামী ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
মক্কায় ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাস
মহানবীর জন্মের সময় মক্কার ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বিশেষ পূর্বাভাস প্রচলিত ছিল। একজন ইহুদি ব্যবসায়ী কুরাইশদের মজলিশে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ রাতে একজন নবী জন্মগ্রহণ করেছেন, যার কাঁধে ঘোড়ার লেজের মতো একটি বিশেষ চিহ্ন থাকবে।’ এই চিহ্নটি ছিল নবুয়তের মোহর (খাতামুন নুবুওয়া), যা পরবর্তীতে মহানবীর কাঁধে স্পষ্ট দেখা যায়।
তিনি আরও বলেছিল, নবীর জন্মের পর প্রথম দুই দিন তিনি স্তন্যপান করবেন না, কারণ একজিন তার মুখে আঙুল ঢুকিয়ে স্তন্যগ্রহণে বাধা দেবে। মহানবীর মা আমিনা (রা.) এ সত্য স্বীকার করেন যে নবী প্রথম দুই দিন স্তন্য পান করেননি। (ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশাম)
এই পণ্ডিত নবীর নবুয়তকে ইসরায়েলের নবী ইয়াকুবের বংশ থেকে হওয়া বলেছিলেন, যা ইহুদি পণ্ডিতদের কাছে ছিল এক অপ্রত্যাশিত তথ্য।
মদিনার ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাস
মদিনা (তৎকালীন ইয়াসরিব) ছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে বনু কুরাইজা, বনু নাজির ও বনু কাইনুকা গোত্রের ইহুদিরা বসবাস করত এবং তাদের পণ্ডিতদের মধ্যেও নবীর আগমনের পূর্বাভাস ছিল।
হজরত হাসান ইবনে সাবিত (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি যখন সাত-আট বছর বয়সে ছিলাম, তখন মদিনার এক ইহুদি পণ্ডিত ঘোষণা করেছিল, ‘আহমদের নক্ষত্র উদিত হয়েছে, যিনি আজ রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন।’
পণ্ডিতরা নবীর শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করেছিলেন- মাঝারি উচ্চতার, চোখে হালকা লালিমা, সাধারণ কাপড় পরিধানকারী, গাধায় চড়া, কাঁধে তরবারি বহনকারী।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তীতে মহানবীর জীবনে প্রমাণিত হয়, বিশেষ করে হিজরতের সময় গাধায় চড়া ও তরবারি বহনের ঘটনা।
ধর্মগ্রন্থভিত্তিক প্রত্যাশা ও কোরআনের বয়ান
ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাস ছিল তাঁদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে। কোরআনে এই সত্য সুনিশ্চিত হয়েছে- ‘যারা সেই রাসুলের অনুসরণ করে, যাকে তারা নিজেদের তাওরাত ও ইঞ্জিলে পায়, যিনি সৎকাজের নির্দেশ দেন ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখেন।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ১৫৭)
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহ প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, যদি মুহাম্মদ (সা.) তাদের সময়ে আসেন, তারা তাকে গ্রহণ করবে। এছাড়া, মদিনার ইহুদি পণ্ডিতরা নবীর আগমনের স্থান হিসেবে মক্কা ও ইয়াসরিবের নাম জানতেন, যা পরবর্তীকালে মহানবীর হিজরতের পটভূমি তৈরি করে।
অলৌকিক ঘটনা ও প্রমাণ
মহানবীর জন্মের সময় কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, যা ইহুদি পণ্ডিতদের পূর্বাভাসের সত্যতা প্রমাণ করে। নবীর মা আমিনা বর্ণনা করেন, জন্মের সময় এক আলো (নুর) শামের প্রাসাদগুলো আলোকিত করেছিল। জন্মের রাতে আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র উদিত হয়েছিল, যা ইহুদি পণ্ডিতরা ‘আহমদের নক্ষত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তবে অনেক ইহুদি পণ্ডিত পরবর্তীতে নবুয়তকে অস্বীকার করেন, যা ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষ ও গোঁড়ামির প্রতিফলন। কোরআন এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, ‘যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি কিতাব এলো যা তাদের কিতাবের সত্যতা নিশ্চিত করে, তখন তারা তা অস্বীকার করল।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ৮৯)
সালমান ফারসির (রা.) সাক্ষ্য
সালমান ফারসি, একজন ফারসি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি, যিনি খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে মহানবীর আগমন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। তার একজন শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, ‘একজন নবী আরব ভূমিতে আসবেন, যিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন কিন্তু সদকা নেবেন না, এবং তার কাঁধে নবুয়তের মোহর থাকবে।’
সালমান মদিনায় এসে মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাঁধে নবুয়তের মোহর দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই ঘটনা ধর্মগ্রন্থভিত্তিক পূর্বাভাসের এক শক্তিশালী প্রমাণ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন