ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সালাত বা নামাজ দ্বিতীয়। পবিত্র কুরআনের পরিভাষায় ‘সালাত’ শব্দটি দোয়া, দরুদ, প্রতিদান, আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়া, তার নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কুরআন, হাদিস এবং ইজমা দ্বারা সালাতের ফরজিয়াত প্রমাণিত। রাসূল (সা.)-এর আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ সর্বসম্মতভাবে সালাতের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও অপরিহার্যতা স্বীকার করে এসেছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কি জীবনের মিরাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়। ঈমানের পর নামাজের স্থান। একজন মুসলমানের ঈমানের বাস্তব প্রকাশ ঘটে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে। নামাজ শুধু আল্লাহর আদেশ পালন নয়; বরং এটি স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথ প্রশস্ত করে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘বান্দা সিজদারত অবস্থায় তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়।’ (মুসলিম)
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রমাণ পাওয়া যায়, পূর্ববর্তী নবীগণের ওপরও সালাত ফরজ ছিল। যেমন, সূরা মারইয়ামের ৫৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে- আল্লাহর প্রিয় নবীরা যখন করুণাময়ের আয়াত শুনতেন, তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন ও অশ্রু বিসর্জন করতেন।
সূরা ইবরাহিমের ৪০ নম্বর আয়াতে ইবরাহিম (আ.) দোয়া করছেন- ‘হে আমার রব, আমাকে ও আমার বংশধরদের নামাজ কায়েমকারী করো।’
সূরা লোকমানের ১৭ নম্বর আয়াতে লোকমান (আ.) তার পুত্রকে উপদেশ দিচ্ছেন- ‘হে বৎস! নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজে আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ করো ও ধৈর্য ধারণ করো।’
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে সূরা ইবরাহিমে বলা হয়, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে, তাদের বলো যেন তারা নামাজ কায়েম করে।’ (১৪:৩১)।
সূরা হজের ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা রুকু করো, সিজদা করো, তোমাদের রবের ইবাদত করো এবং সৎকাজ করো, যাতে তোমরা সফল হও।”
সূরা ত্বহার ১৩২ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আপনার পরিবারবর্গকে নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও তাতে অবিচল থাকুন।’
সূরা বাকারা ৪৩ ও ২৩৮ আয়াতে যথাক্রমে বলা হয়েছে- ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’ এবং ‘তোমরা নামাজসমূহের হেফাজত করো, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের।’ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘মধ্যবর্তী নামাজ’ বলতে আসরের নামাজ বোঝানো হয়েছে।
নামাজ না পড়ার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবার্তা রয়েছে হাদিসে। বুখারি শরিফের হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আসরের নামাজ ছেড়ে দিল, সে যেন তার পরিবার ও ধনসম্পদ হারাল” (১/৫৫২)। পরের হাদিসে বলা হয়েছে, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে আসরের নামাজ ছেড়ে দিয়ে পরে তা আদায় করলে তা আদায় হবে না’ (১/৫৫৩)।
সালাত আদায়কারীদের সফলতার কথা বলা হয়েছে সূরা মুমিনুনের প্রথম আয়াতে- ‘ঈমানদারগণ সফলকাম হয়েছে, যারা নামাজে বিনয়ী ও নম্র।’ আর নামাজ না পড়ার শাস্তি সম্পর্কে সূরা মুদাসসিরে বলা হয়েছে- ‘কি অপরাধে তোমরা দোজখে গেলে? তারা বলবে- আমরা সালাত আদায় করতাম না।’ (৭৪:৪২-৪৩)
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ।’ (মুসলিম) নামাজ কেবল ইবাদত নয়, বরং এটি খারাপ কাজ ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে (সূরা আনকাবুত: ৪৫)। চিন্তায় ক্লান্ত হলে রাসূল (সা.) নামাজে দাঁড়াতেন। সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো।’
নামাজের রয়েছে দুটি রূপ- ফরজ ও অতিরিক্ত (সুন্নত, নফল)। ফরজ সালাত হলো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের ১৭ রাকাত নামাজ। এগুলো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত, রোগী-সুস্থ, মুকিম-মুসাফির সবার জন্য ফরজ। ১০ বছর বয়স হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তা আদায় করা অপরিহার্য। অন্য ফরজ ইবাদতের মতো নয়, নামাজ সব সময়, সব অবস্থায় ফরজ।
মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে। সূরা ত্ববীনে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে উত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছি’ (৯৫:৪)। এবং সূরা যারিয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি’ (৫১:৫৬)। এই ইবাদতের মধ্যে সর্বপ্রথম ফরজ সালাত আদায় করা। এরপর রয়েছে হালাল রুজি উপার্জন, সদাচরণ, দায়িত্ব পালন ইত্যাদি।
অতএব, সালাত কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একজন মুসলমানের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এটি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার শক্তিশালী মাধ্যম। ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ পরিত্যাগ করা মারাত্মক অপরাধ এবং ঈমান হানিকারক। তাই নামাজের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া, নিয়মিত আদায় করা এবং অন্যদের উৎসাহিত করাই একজন মুসলমানের দায়িত্ব।