নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার দাউদপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ঢুকলেই চোখে পড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা। পুরোনো টিনশেডের শ্রেণিকক্ষগুলো তালাবদ্ধ, ভেতরে ধুলোমাখা বেঞ্চ-টেবিল। কোথাও ভাঙাচোরা আসবাব এক পাশে স্তূপ করে রাখা, জানালা-দুয়ারে মাকড়সার জাল।
দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি একটি চলমান এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাকি পরিত্যক্ত ভবন। পাশেই নতুন ভবন আছে, যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলে।
মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, কাগজে-কলমে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০৪ জন।
কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীও উপস্থিত নেই। নেই পাঠদান, নেই পরীক্ষা বা নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের কোনো চিহ্ন।
অথচ এই শাখায় কর্মরত রয়েছেন চার জন শিক্ষক। হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর রয়েছে, মাস শেষে বেতনও উত্তোলন করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও কোনো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলছিল না। অফিস কক্ষে বসে মোবাইল ফোনে সময় কাটাতে দেখা যায় তাদের। পাশের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকায় দূর থেকে পুরো চিত্র বোঝা কঠিন হলেও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষগুলো ছিল সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী শূন্য।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে কার্যত কোনো শিক্ষার্থী নেই। শুধু কাগজে উপস্থিতি দেখিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু দেখানো হয়। এর আড়ালে নিয়মিত বেতন ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে।
স্থানীয়রা বলেন, প্রশাসনিক তদারকির অভাবেই এমন অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারছে। এলাকাবাসী ও অভিভাবকদের ক্ষোভ চরমে।
আলতাব ও সোহেল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থী ছাড়াই শিক্ষক বহাল রাখা বড় ধরনের দুর্নীতি। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্য বিষয়টি আংশিক স্বীকার করলেও দায় চাপাচ্ছেন উপবৃত্তি না পাওয়া এবং পাশের দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর।
কাগজে শিক্ষার্থী হিসেবে যাদের দেখানো হয়েছে, তাদের মধ্যে সাজিদ ও আরিফ নামে কয়েকজন বলেন, তারা দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসায় পড়েন না। পাশের দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন।
আর আজমাইন নামে একজন প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী জানায়, সে বদলগাছী সদরের একটি মাদ্রাসায় নিয়মিত পড়াশোনা করছে।
দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার আলী সেকেন্দার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘কিছু শিক্ষার্থী আছে, তবে উপবৃত্তি না থাকায় তারা নিয়মিত আসে না। আগামী বছর প্রচুর শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে।’
ইবতেদায়ী শাখার চার শিক্ষক তহুরা খাতুন (ইবতেদায়ী প্রধান), রেজাউল করিম (মৌলভী), শরিফুল ইসলাম (সাধারণ শিক্ষক), সুফিউল্লাহ (ইবতেদায়ী কারি) একই সুরে জানিয়েছেন, উপবৃত্তি না থাকায় শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় আসছে না। ‘আমরা নিয়মিত মাদ্রাসায় আসি। আগামী বছর শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিউল আলম বিষয়টি সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি তাদের লিখিত জবাব চেয়েছি। যেহেতু মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে রয়েছে, আমরা মাদ্রাসা বোর্ডকে বিষয়টি অবগত করব।’
দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জুয়েল সরদার বলেন, ‘গত তিন মাস আগে আমি সভাপতি হয়েছি। শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর নির্দেশ দিয়েছি।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান ছনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমি সেখানে গিয়েছি। শিক্ষার্থী নেই কেন জানতে চেয়েছি। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে এ বিষয়ে অবগত করব।’
স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষার্থী না থাকলেও বছরের পর বছর চার জন শিক্ষক কীভাবে বহাল আছেন? কার তদারকিতে চলছে এই কাগুজে শিক্ষা কার্যক্রম? সরকারি অর্থের দায় নেবে কে? দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার এই চিত্র এখন কার্যকর শিক্ষা প্রশাসনিক নজরদারির দাবি জাগাচ্ছে।



