ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে এক ছাত্রী হেনস্তার অভিযোগে আটক এক যুবককে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে বুধবার রাতভর বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়েছে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে একদল ব্যাক্তি।
পরে অভিযুক্ত ওই যুবককে পুলিশ আদালতে হাজির করা হলে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জামিন পান। জামিনে মুক্ত হলে তাকে ফুলের মালায় বরণ করে ওই গ্রুপের সদস্যরা। এমনকি আদালত প্রাঙ্গণে ওই যুবকের মাথায় সাদা পাগড়ি পরিয়ে দেন তারা। পাশাপাশি যুবকের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় পবিত্র আল-কুরআন।
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এরআগেই ‘তৌহিদী জনতা’ নামে একদল ব্যাক্তির কিছু কার্যক্রম সামনে এসেছে। ফলে অনেকেই ‘তৌহিদী জনতা’ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন।
এমন আলোচনার মধ্যেই ‘তৌহিদী জনতা’র আড়ালে কারা? তা নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকবিষয়ক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির। তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ওই গ্রুপ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
                                    
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিস্তারিত পোস্ট দিয়েছেন সাংবাদিক কদরুদ্দিন শিশির। ওই পোস্টে লিখেছেন যে, তিনি ঢাবিতে ছাত্রী হেনস্তার অভিযুক্ত যুবকের মুক্তির চেষ্টাসহ সাম্প্রতিক ৩টি ঘটনার কিছু ছবি/ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছেন।
অন্য দুটি ঘটনা হলো- গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম আলো পত্রিকার সামনে ২ দিনব্যাপী বিক্ষোভ ও গরু জবাই কর্মসূচি এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার ভবনের গেট বন্ধ করে বিক্ষোভ ও জুমার নামাজ আদায় কর্মসূচী।
ওই তিনটি ঘটনায়ই ৩জন ব্যাক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছেন। তবে এদের মধ্যে দুজনের নাম পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন।
এরমধ্য একজন আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ খান, যার ফেসবুক প্রোফাইল Sher Muhammad। তাকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার অর্থ সরবরাহকারী সদস্য হিসেবে আটক করে র্যাব।
সে অনলাইন শরিয়াহ গ্রাজুয়েশন ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ৫ আগষ্টের পর আল-ক্বায়দার কালো পতাকার সমর্থনে প্রচারণা চালাতে দেখা যায় তাকে। ২০১৫ সালে হাটহাজারিতে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে বিক্ষোভে তাকে নেতৃত্ব দিতে একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে। শাহবাগের গত রাতের ঘটনায় তাকে ‘আমির’ হিসেবে ঘোষণা করে একটি ভিডিও বক্তব্য দিয়েছেন আতাউর রহমান বিক্রমপুরী।
                                    
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী। তিনি প্রথম আলোর সামনের বিক্ষোভে এবং সেখান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া কয়েকজনকে থানা থেকে জোরবপূর্বক ছাড়িয়ে নেয়াতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং শাহবাগ থেকে নারী হয়রানিকারী ছাড়িয় নিতেও তিনি যশোর থেকে ঢাকায় এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিক্রমপুরী তার ওয়াজ, অনলাইন বয়ান ও ফেসবুকে অতিউগ্র কথাবার্তা প্রচারের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি তিনি তার এক ফেসবুক পোস্টে বায়তুল মোকাররামের বর্তমান খতীব মাওলানা আব্দুল মালেককে মুনাফেক এবং “তাগুতের কুকুর” বলে অভিহিত করেন।
এছাড়া তিনি ‘এন্টি শাতিম মুভমেন্ট’ নামে একটি ফেসবুক পেইজ চালান যেখানে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে ‘শাতিমে রসুল’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা গেলে তাকে হত্যার আহ্বান জানানো হয়।
‘গণতন্ত্র চর্চাকারী মুসলিমদেরকে ‘কাফির’ মনে করে তিনি নিয়মিত পোস্ট করেন এবং বয়ান করেন। নাস্তিকদের হত্যা করার জন্যও তিনি উস্কানি দেন। আইএসকে খারেজি মনে করলেও আল-কায়দা ও তালিবানকে হক্বপন্থী দল বলে প্রচারণা চালান।’ বলে সাংবাদিক কদরুদ্দিন শিশির তার পোস্টে লেখেন।
তিনি আরও লিখেন, ‘২০২১ সালে তাকে (আতাউর রহমান বিক্রমপুরী) আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। আতাউর কারাগারে থাকা জঙ্গিদের মুক্তির জন্য কাজ করা বৈষম্যহীন কারামুক্তি আন্দোলনের একজন কেন্দ্রিয় সমন্বয়ক। এবং ৫ আগস্টের পর তিনি তার দলবল নিয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের মুক্ত করে আনার জন্য জড়ো হয়ে কর্মকর্তাদের জেরা করেন।
তবে তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি উপরের তিনটি ঘটনায়ই শের মোহাম্মদের পাশে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে কিন্তু তার পরিচয় জানা যায়নি।
পরে আরেকটি পোস্টে কদরুদ্দিন শিশির লিখেন, উপরের ৩টি স্থানে মবকে নেতৃত্ব দেয়া তৃতীয় যে ব্যক্তিটির পরিচয় তখন পাইনি তিনি হচ্ছেন মোহাম্মদ তামিম (তার ফেসবুক আইডি মতে)। তিনি সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের ছাত্র বলে অনলাইনে পাওয়া ওই কলেজের একটি ভিডিও থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এছাড়া তার বাসা মিরপুর ১০ এলাকায় বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার এক বাসিন্দা যিনি তামিমকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তিনি আরও জানান যে, তামিম কয়েক বছর আগের উগ্রপন্থী কার্যকলাপের জন্য গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং পরে জামিনে বের হন।
কদরুদ্দিন শিশির পরের পোস্টে আরও লিখেন, তামিমের ফেসবুক আইডিতে ৫ আগস্টের পর এক পোস্টেও তার ২০১৫ সালে কারাগারে থাকার স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তার গ্রেফতার হওয়ার পেছনের কারণ কী ছিল সেটির উল্লেখ নেই। আমিও অনলাইনে কোন ক্রেডিবল সূত্র থেকে তার গ্রেফতারের পেছনের কারণটি পাইনি। পেলে পোস্টে আপডেট করে দেব।
‘অর্থাত, ‘তৌহিদী জনতা’র স্বতস্ফুর্ত কাণ্ড বলে প্রচার চালানো হলেও দেখা যাচ্ছে এই ঘটনাগুলোতে মানুষ জড়ো করার পেছনে উগ্রপন্থী কর্মকান্ডের সাথে সক্রিয় ব্যক্তিদের কো-অর্ডিনেশনের বিষয়টি স্পষ্ট।’ প্রথম লিখেন কদরুদ্দিন শিশির।
তিনি পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘প্রথম আলোর সামনের ঘটনাটির মূল আয়োজক কয়েকজন ব্যক্তি যেমন আবু মোস্তাফিজ হাসান, মাসুদ জাকারিয়া প্রমুখ যারা উগ্রপন্থা বিরোধী হিসেবেই পরিচিত। তবে তাদের কর্মসূচিতে উপরিউক্ত তিন ব্যক্তিকে সক্রিয় থাকতে এবং বিশেষ করে থানা থেকে আটকদের ছাড়িয়ে নিতে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।’
                                    
শাহবাগ থানার ঘটনা উল্লেখ করে ‘তৌহিদী জনতা’র আড়ালে কারা?’ শিরোনামে দেয়া পোস্টের শুরুতে কদরুদ্দিন শিশির লিখেন, ‘এই ঘটনাটিকে আরো অনেক ঘটনার মতো ‘তৌহিদী জনতা’র কাণ্ড বলে প্রচার করা হচ্ছে। এখানে ‘তৌহিদী জনতা’ বলতে ‘ধার্মিক আমপাবলিক’ বলেই বুঝানো হচ্ছে।’
‘কিন্তু এই ঘটনার সাথে সাম্প্রতিক অতীতে আরও কয়েকটি ঘটনার ছবি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, শাহবাগের এই ঘটনাটি (এবং এরকম ‘তৌহিদী জনতা’র কাণ্ড বলে চালানো) আরও অনেক ঘটনা রেন্ডম ‘ধার্মিক আমপাবলিক’ এর তাতক্ষণিক ক্ষোভ থেকে উতসারিত স্বতস্ফুর্ত ঘটনা নয়। বরং এগুলো কো-অর্ডিনেটেড ঘটনা।’
প্রসঙ্গত, গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ওই নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্থার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযুক্তের ছবি যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপে হেনস্তার ব্যাপারে পোস্ট করেন ভুক্তভোগী ছাত্রী নিজেই।
পরে তার সহপাঠীরা অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফকে খুঁজে বের করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান এবং অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর ভুক্তভোগীর মামলার প্রেক্ষিতে প্রক্টর অফিস থেকে তাকে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয়।
যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযুক্তকে থানায় গ্রেপ্তারের পাশাপাশি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে গুজব ছড়িয়ে তার পক্ষে অবস্থান নেয় ‘তৌহিদী জনতা’ নামের গোষ্ঠীটি।
ফেসবুকে আহ্বান জানিয়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে তারা শাহবাগ থানায় গিয়ে অভিযুক্তকে ছাড়িয়ে আনতে ‘মব’ তৈরির চেষ্টাও করেন।
তাছাড়া ভুক্তভোগী মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার জন্যও জোরাজুরি করতে থাকেন তারা।
এমনকি ভুক্তভোগী ছাত্রীর মামলার নথি থেকে তার পরিচয় বের করে তাকে মেসেঞ্জারে কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে সেগুলো ফেসবুকে উন্মুক্ত করে দেন।
এভাবেই চলে রাতভর। পরে আদালতে হাজির করানো হলে অভিযুক্ত আসিফ জামিনে মুক্ত হলে তাকে ফুলের মালায় বরণ করা হয়।




