ঢাকা সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

‘সহজ শর্তে ঋণের’ ফাঁদে সর্বনাশ

ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৫, ১১:৩২ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

ডিজিটাল যুগের সুবিধা এখন ভয়ঙ্কর প্রতারণার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারকচক্র নানা কৌশলে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। বিশেষ করে অনলাইন-ভিত্তিক ভুয়া ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা এখন নতুন আতঙ্কের নাম। ‘সহজ শর্তে ঋণ’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসংখ্য মানুষকে ফাঁদে ফেলছে এসব প্রতিষ্ঠান।

ফেসবুক বা ইউটিউবের বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই এসব অ্যাপ ডাউনলোড করে নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অনুমতি দিয়ে দেন অজান্তেই। এরপরই শুরু হয় প্রতারণার বাস্তব খেলাযেখানে মানুষ হারাচ্ছেন টাকা, সম্মান ও নিরাপত্তা সবকিছু।

অনলাইন-ভিত্তিক এসব ভুয়া ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন হাজারো মানুষকে ঠকিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। তাদের অধিকাংশেরই বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় বা মাইক্রোক্রেডিট অথরিটির কোনো অনুমোদন নেই। অথচ তারা এমনভাবে প্রচারণা চালায় যেন রাষ্ট্র স্বীকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ লেনদেনের আড়ালে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে পরে তা ব্যবহার করে ভয় দেখায়, ব্ল্যাকমেইল করে, এমনকি সামাজিকভাবে হুমকির মুখে ফেলে অর্থ আদায় করে নেয়।

ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতাও একই রকম। অনলাইন উদ্যোক্তা জান্নাত বলেন, ‘সম্প্রতি অনলাইনে একটি অ্যাপ ৩০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলে মাত্র ৩০০ টাকা দেয়। পরে আমার ব্যক্তিগত নম্বরে মেসেজ করে জানানো হয়, সেই টাকার বিপরীতে এক হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে টাকা না দিলে ব্ল্যাকমেইল শুরু হয়, ছবি ও তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয় তারা।’

জান্নাতের মতো অসংখ্য মানুষ অভাবে পড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখছেন, কিন্তু পরে সেই বিশ্বাসে ট্র্যাপে পরে জান তাদের। কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়াই বিশ্বাস করে তারা টাকা দিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে টাকা নেওয়ার নাম করে ব্ল্যাকমেইল করে। যার ফলে কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন, কেউবা আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে ঋণ ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে অনুমোদন ও নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কোনো আইন মানছে না। বরং তারা নীরবে পরিচালনা করছে এক বিশাল অবৈধ অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক। ফেসবুক বিজ্ঞাপন, ইনস্টাগ্রাম রিল কিংবা ইউটিউবের প্রচার—সবখানেই এই ভুয়া অ্যাপগুলোর জাল ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষ সহজে ঋণ পাওয়ার আশায়, বা আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি চেয়ে এই অ্যাপগুলোর ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে, ঋণ নয় এটি আসলে এক ধরনের ডিজিটাল শোষণ।

এই প্রতারণায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই মানুষরা, যারা অল্প পুঁজিতে জীবিকা টিকিয়ে রাখতে চান বা ক্ষুদ্র ঋণের আশায় নির্ভরশীল। তারা অজান্তে নিজের ছবি, পরিচয়, তথ্য ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছেন অপরাধীদের হাতে। এরপর শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল, হুমকি আর মানসিক নির্যাতন। প্রতারকরা তাদের ছবি বা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করে, অনেক সময় তাদের পারিবারিক সম্মান পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলে।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়েছে, সাইবার অপরাধের মধ্যে সর্বাধিক ২৩.৭৯ শতাংশই সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং সম্পর্কিত যার একটি বড় অংশ এই ভুয়া ঋণ অ্যাপ প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। এসব অপরাধী জানে, অনভিজ্ঞ ব্যবহারকারীর আবেগ, প্রয়োজন ও অজ্ঞতাই তাদের সবচেয়ে বড় মূলধন। তাই তারা মানুষের বিশ্বাসকে মূলধন করে অর্থ লুটে নিচ্ছে নির্দ্বিধায়।

এখন সময় এসেছে রাষ্ট্র ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। এই ভুয়া ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শনাক্ত করে বন্ধ না করা গেলে অনলাইন প্রতারণা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিটি আর্থিক অ্যাপের যাচাই, রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ প্রতারক চক্রের শক্তি আমাদের অজ্ঞতা ও অতি বিশ্বাস। ডিজিটাল বাংলাদেশ তখনই সফল হবে, যখন অনলাইন নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রে থাকবে এবং প্রতারণার এই অন্ধকার অর্থনীতি নির্মূল হবে আইন, প্রযুক্তি ও সচেতনতার সমন্বয়ে।