বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


তরিক শিবলী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৪, ০১:৩৮ এএম

হাজার কোটি টাকার মালিক মাছ বিক্রিতা নাঈম

তরিক শিবলী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৪, ০১:৩৮ এএম

হাজার কোটি টাকার মালিক মাছ বিক্রিতা নাঈম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আনিসুর রহমান নাঈম। উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৯নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। পাশাপাশি তার আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি উত্তরা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকও। তবে কাওলাবাসীর কাছে দখল ও চাঁদাবাজ হিসেবে তার পরিচিতিটাও কম নয়। স্থানীয়দের কাছে তিনি আতঙ্ক ও ত্রাসের নাম। তার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। যাদের কাজই হলো অন্যের জমি দখল, বিভিন্ন ফুটপাথ, যানবাহন ও প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি করা। কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালেই চলে তার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এলাকায় কারও জমি দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে আর রক্ষা নেই। নাঈম সুযোগ বুঝে রাতের আঁধারে দখল করে নেন। কখনো প্রকাশ্যেই দখলবাজি করেন। জোরজবরদস্তি সিভিল অ্যাভিয়েশনের সরকারি জমি, পুকুর, জলাশয় দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। নাঈমের এসব শুরু ২০০৯ সালের পর থেকে।

উত্তর সিটি কপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার পর দ্রুতই নাঈমের পরিবারের আর্থিক উন্নতি হয়েছে। যারা একসময় হাটে সবজি ও মাছ বিক্রি করতেন, তারা এখন বিত্তশালী এবং গাড়ি-বাড়ির মালিক। এর নেপথ্যে রয়েছে অবৈধ দখলবাণিজ্য।

বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত নাঈমের বিরুদ্ধে রয়েছে জমিদখল, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, অত্যাচার-নির্যাতনের বিস্তর অভিযোগ। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেই তিনি সম্পদশালী হয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

রাজধানীর বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব বাহিনী। তারা এলাকায় ‘নাঈম খলিফা’ হিসেবে পরিচিত।

নাঈমের আলোচিত ভিডিও যেটি সর্বাধিক ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে দেখা যায়, রাতে নববধূকে সামনে রেখে শটগান উঁচিয়ে আকাশে গুলি ছুড়ছেন নাঈম। আর পাশে থাকা তার বউ ভয়ে কানে আঙুল দিয়ে রেখেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুন আত্মীয় হওয়ার সুবাদে ‘তদবির-বাণিজ্য’ করে কাউন্সিলর হওয়ার আগেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন নাঈম। কাউন্সিলর হওয়ার পর তিনি এখন বেশুমার সম্পদের মালিক।

প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র থাকার সময় বিমানবন্দর পাবলিক টয়লেট ফয়েজ নামে এক ব্যক্তিকে ইজারা দেন। তার মৃত্যুর পর ওই টয়লেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পান আবদুল হান্নান ওরফে ‘জাপানি হান্নান’। তার হয়ে এটি দেখাশোনা করতেন রোকন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ডিএনসিসি সেটি দখলমুক্ত করে। মোটর বসিয়ে অবৈধভাবে পানি বিক্রির অভিযোগে রোকনকে তিন মাসের সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার টয়লেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেন নজরুল ইসলাম মোহনকে। তিনি উত্তরা পূর্ব থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কাগজপত্রে টয়লেটটি মোহনের ব্যবস্থাপনায় থাকলেও তাজুল নামে এক ব্যক্তি সেটি দখল করে নিয়েছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাঈমের নির্দেশে তিনি এটি দখল করেন। টয়লেটে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন তাজুল। নাঈমকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অর্থ দিতেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, ‘এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট’ চত্বর ঘিরে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে বেশ কয়েকটি হোটেল ও দোকানপাট। এসব দোকানে টয়লেট থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিদিন ওই টয়লেট থেকে বিক্রি হতো হাজার হাজার গ্যালন পানি। অসংখ্য মোটরসাইকেল ও গাড়ি ধোয়ার কাজও চলত এ টয়লেট থেকে। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় হয়। কিছু অংশ সিটি করপোরেশনে দিয়ে বাকিটা নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিত।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নাঈম ও তার পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দর গোলচত্বরের পূর্বপাশের বাবুস সালাম মসজিদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স মার্কেট দখল করে নিয়েছেন। এ নিয়ে বিরোধের শুরুর দিকে সেখানে নাঈম বাহিনীর হামলায় তিন নারীসহ চারজন আহত হন।

এ নিয়ে বিমানবন্দর থানায় নাঈমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন হামলায় গুরুতর আহত ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে প্রিন্স। 
এজাহারে নাঈমের নেতৃত্বে মার্কেট দখলে নিতে কয়েক দফা হামলার অভিযোগ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

এ ছাড়া মসজিদ কমপ্লেক্স দখল করায় আদালতে মামলা করেছেন বাবুস সালাম ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি সৈয়দ মোস্তফা হোসেন। এতে কাউন্সিলর নাঈম ছাড়াও মোতালেব মুন্সী, আনিছুর রহমান ও মামুন সরকারকে আসামি করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়, কাউন্সিলর নাঈম নিজেকে প্রিন্সিপাল দাবি করে কমপ্লেক্সটি দখল করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দখল ও চাঁদাবাজি করছেন। ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করায় নাঈম ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে।

মসজিদ দখল নিয়ে স্থানীয়রা বলছেন, মসজিদে দান ও মার্কেট থেকে মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হয়। নাঈম জোর করে দোকানগুলোর ভাড়া নিয়ে যেত। কমপ্লেক্সের টাকা ইচ্ছেমতো ব্যয় করতেন। তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করেন না।

এদিকে বিমানবন্দর এলাকায় চাঁদাবাজি সম্পর্কিত পুলিশের এক প্রতিবেদনে নাঈমের চাঁদাবাজির বিষয়টি উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, তাজুল ইসলামের মাধ্যমে কসাইবাড়ি পাবলিক টয়লেট থেকে মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাবলিক টয়লেট থেকে দক্ষিণখান থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি বাবু ওরফে ‘জামাই বাবুর’ মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার টাকা, আশিয়ান সিটি হয়ে দক্ষিণখান বাজার-গাওয়াইর রুটে ইজিবাইক থেকে মাসে ১ লাখ টাকা, কাওলা রেলগেট থেকে শিয়ালডাঙ্গা হয়ে দক্ষিণখান বাজার রুটে চলাচল করা অটোরিকশা থেকে আজমের মাধ্যমে মাসে ১ লাখ টাকা, কসাইবাড়ির ছয়টি বাস কাউন্টার থেকে জান্নাতের মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার টাকা, কসাইবাড়ি টায়ারপট্টি ফুটপাত থেকে জান্নাত ও আজমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার টাকা, আশকোনা রেলগেট থেকে হাজী ক্যাম্প পর্যন্ত ফুটপাতে ‘জামাই বাবুর’ মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা, বাবুস সালাম মসজিদ মার্কেটের দুটি আবাসিক হোটেল থেকে ম্যানেজার মনিরের মাধ্যমে দৈনিক ১৫ হাজার টাকা করে মাসে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রেলস্টেশন ও রেললাইনের পূর্বপাশে পার্কিংয়ের দোকান (পুকুরপাড়) থেকে সাজু ও রুবেলের মাধ্যমে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, রেললাইনের পশ্চিম পাশে শাহীন আক্তারের মাধ্যমে দৈনিক সাড়ে ১০ হাজার টাকা হিসেবে মাসে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা আদায় করতেন কাউন্সিলর নাঈম।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নাঈম ও তার লোকজন স্থানীয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ও কলেজের পাশের মাঠে তাঁতমেলার নামে মেলা বসিয়ে জুয়ার আসর চালান। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর মেলা বন্ধ করে সেখানে মাছ, সবজি ও ফলের বাজার বসানো হয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে ৮-১০ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে দৈনিক হিসেবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

তারা আরও জানান, নাঈম ও তার লোকেরা আশকোনায় নির্মাণাধীন র‌্যাব কার্যালয়ের পাশে একটি লেক দখল করতে যান। প্রথমে মাছ চাষের কথা বলে সেখানে ঘর তৈরির চেষ্টা করেন তারা। পরে র‌্যাবের লোকজন নাঈমকে ডেকে নিয়ে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়।

এলাকাবাসীর দাবি, কাওলা এলাকায় আশিয়ান সিটির প্রবেশমুখের কাছে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি দখল করেছেন নাঈম ও তার লোকজন। সেখানে অবৈধ বাস টার্মিনাল ও রিকশা গ্যারেজ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলরের কার্যালয়ও করা হয়েছে সেখানে। কাউন্সিলরের কার্যালয় বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া কাওলাবাজার এলাকাতেও নাঈমের একটি কার্যালয় রয়েছে। কাওলা সিভিল এভিয়েশন স্টাফ কোয়ার্টারে সংস্কার-নির্মাণকাজসহ যেকোনো ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাঈম বাহিনী’। তারা ঢাকা কাস্টম হাউসেরও কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যার থেকে তাদের বিশাল অর্থ আসে।

নুরুল আক্তার বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে ডিএনসিসি’র ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের গাওয়াইর, আশকোনা ও হাজী ক্যাম্প এলাকার বাসাবাড়ি, দোকানপাট, মার্কেট ও বাজার রাস্তা থেকে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ ও অপসারণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০২০ সাল থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নীতিমালা যথাযথ পালন করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কিন্তু কাউন্সিলর নাঈমের নির্দেশে তার দুই সহযোগী রাজু ও মাসুদ নিয়মিত চাঁদা দাবি করত। চাঁদা না দেওয়ায় আসামিরা বর্জ্য অপসারণের তিনটি ভ্যান গাড়ি নিয়ে যায়। চাঁদার টাকা না পেয়ে ভ্যানচালক আনোয়ার হোসেন ও রেফাজকেও মারধর করে আসামিরা। এ ছাড়া মেরে ফেলা ও গুম করার হুমকিও দেওয়া হয়।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার চাঁদাবাজ নাঈমকে শ্রেষ্ঠ কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত করে। শওকত ওসমান মিললনায়তে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। বর্তমানে নাইমের সব সম্পত্তি দেখাশোনা দায়ভার তার তার স্ত্রী ও শাশুড়ির ওপর। নাঈমের স্ত্রী রুহি কাওলা বাজার জামতলায় বিশ কোটি টাকা দামের ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকেন বলে জানান।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি উত্তরা রাজলক্ষ্মীর সামনে ৩০ কোটি টাকা মূল্যের নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে থাকেন।

খিলক্ষেতে অবস্থিত জেসেল টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক নাঈম নিজেই। শেখ হাসিনা পালানোর পর নাঈম তার এই ট্রাভেলসের মাধ্যমে ইন্ডিয়া পালিয়ে যান। উত্তরের সব থানা মিলিয়ে নাঈমের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে প্রায় ৩০টির উপরে মামলা রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার থাকার সময় থেকে এখন পর্যন্ত দুদকে তার বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ জমা আছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!