বাংলাদেশ জামায়াতের ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এখন বেশ কাছাকাছি। ঘনিষ্ঠতাও বাড়ছে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে। শুধু ঘনিষ্ঠই হচ্ছে নয়, এক সঙ্গে চালাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে একটি ‘বৃহত্তর সমঝোতার জোট’ গড়ার প্রক্রিয়াও। যেখানে যুক্ত হচ্ছে দেশের সব ইসলামিক দলগুলো। এই প্রক্রিয়ায় টানছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও।
দল দুটির নেতারাও বলছেন, তাদের এখন একটি মাত্র লক্ষ্য একটি ‘বৃহত্তর ঐক্যমতের ভিত্তিতে’ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সেখানে যুক্ত থাকবে দেশের প্রায় সব দল। তবে এক্ষেত্রে কোন নির্বাচনী ‘জোট’ গঠন হবে না, বলেও বলছেন নেতারা।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তিনি দলটির কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধানের দায়িত্বেও রয়েছেন।
জানতে চাইলে এহসানুল মাহবুব শনিবার বিকেলে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তেমনটার (নির্বাচনী সমঝোতা বা জোট) আলোচনা চলছে। তবে এখনও সেই প্রক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।’
‘কোনকিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই প্রক্রিয়ার সময় লাগবে। সংস্কার ও জুলাই সনদ হওয়ার পর বুঝা যাবে আমরা আসলে কিভাবে নির্বাচনে যাবো,’ যোগ করেন তিনি।
ইসলামিক জোট হবে দেশের ‘প্রধান রাজনৈতিক শক্তি’
তবে শনিবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের জাতীয় মহাসমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘ইসলামপন্থিদের ঐক্যের ব্যাপারে গণ-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। জোটবদ্ধ ইসলামি দলগুলো হবে আগামী দিনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।’
তার এই বক্তব্য ও দলটির সমাবেশে জামায়াতের ইসলামীর নজর কারা অংশগ্রহণ পরিষ্কার করছে, নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সঙ্গে একটি ‘সমঝোতা বা জোট’ গঠনের পথে রয়েছে। কারণ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জামায়াত একটা নির্বাচনী ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ওই সমাবেশে জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার, হকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও মাওলানা আব্দুল হালিম অংশ নেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের জামায়াতের অনেকে নেতাকর্মী অংশ নেওয়ার কথাও জানা গেছে।
যদিও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব বলেন, ‘তারা (ইসলামিক আন্দোলন) আমাদের দাওয়াত করেছেন। রাজনৈতিক কার্টেসি (সৌজন্যতা) হিসেবে আমাদের চার নেতা অংশ নিয়েছেন।’
জোট হবে না, হবে ‘সমঝোতার জোট’
তবে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহ সম্পাদক শেখ ফজলুল করীম মারুফ রূপালী বাংলাদেশকে অনেকটা জোর দিয়েই বলেন, তাদের মধ্যে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে একটা ঐক্যমত হচ্ছে।
‘আমাদের আমির আজ (সমাবেশে) তো বলেছেনই যে, আগামী নির্বাচনে সব ইসলামি দল ও অন্যান্য দল মিলে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। এখানে ইসলামিক দলগুলোর বাইরে অন্য দলগুলোও থাকবে। আমরা চাচ্ছি আগামী নির্বাচনে একট্টা হয়ে লড়তে। তবে এটি কোন জোট হবে না। আমরা মূলত সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করবো।’
জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে রাজনৈতিক জোট হয়েছে। পরে তা নিয়ে নানা জটিলতাও হয়েছে। তাই আমরা এবার কোন জোট করবো না। আমরা সমঝোতায় নির্বাচন করবো।’
‘ধরুন, আমরা যে আসনে প্রার্থী দেবো সেখানে অন্যরা দেবে না। অথবা অন্যরা যেখানে প্রার্থী দেবে সেখানে আমরা প্রার্থী দেবো না,’ বলেন ফজলুল মারুফ।
সমাবেশে বক্তব্যেও ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের আমির।
‘আমি শুরু থেকেই ইসলামপন্থী সব ভোট একত্র করার কথা বলছি। আগামী নির্বাচনে শুধু ইসলামি দল নয়, বরং দেশপ্রেমিক আরও অনেক দলও এই ঐক্যে যুক্ত হতে পারে। আমরা যদি একক নীতি ও কৌশলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরাই হবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি’, বলেন তিনি।
ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ‘শিগগিরই’
অন্যদিকে, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সব ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যেই বক্তব্য দিয়েছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, ‘দেশের সব ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শিগগিরই সমঝোতা হতে যাচ্ছে।’
‘দেশের ইসলামিক পণ্ডিত, আলেম-উলামারা বুঝতে পেরেছেন, এবারের নির্বাচনে সব ইসলামী শক্তির মধ্যে একটি নির্বাচনি ঐক্য থাকা জরুরি। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অচিরেই সমঝোতা হবে।’
ছাত্র-জনতার অভ্যত্থাণে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এরমধ্যেই দেশের দায়িত্ব নেয় ছাত্র-জনতার সুপারিশে শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর নানা সময় সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের বিভিন্ন সম্ভাব্য সময় জানানো হয়েছে। তবে সবশেষ সরকার প্রধানের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে যেকোন একটি তারিখে নির্বাচন হতে পারে।
‘ইসলামিক জোটে’ যেসব দল যুক্ত হতে পারে
সেই অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। সেই লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাড়াও খেলাফত মজলিস, ফরায়েজী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপিসহ অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
দলগুলোর একাধিক সূত্র বলছে, ধারাবাহিক আলোচনায় এরইমধ্যে ইসলামিক দলগুলোর মধ্যে একটি সু-সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির যে দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল, এখন সেটিও মিটে গেছে।
সবশেষ ইসলামী আন্দোলনের ওপরই নির্ভর করছিল দলগুলোর ঐক্যের বিষয়, তবে এখন সেটিও নিরসন হয়েছে। ফলে নিজেদের মধ্যে এখন আলোচনা চলছে, নির্বাচনের অংশগ্রহণে রূপরেখা নির্ধারণ।
ইসলামিক দলগুলোর একাধিক দায়িত্বশীল নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। তবে সেগুলো পিছনে রেখে বৃহত্তর স্বার্থের দিকেই তাদের নজর। এক্ষেত্রে অতীত নিয়ে কিছু ভাবনা না। তাদের এখন শুধু আগামী নিয়েই ভাবছেন।
একজন নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অতীতে কি হয়েছিল, কি ঘটেছিল- তা আর এখন টানা হচ্ছে না। এখন নতুন বাংলাদেশ গড়তে যা যা প্রয়োজন যেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আর সেজন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প কিছু ভাবছি না।’
আপনার মতামত লিখুন :