গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ। ফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তাদের ঝুঁকতে হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দিকে। এর ফলে গুটিকয়েক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পরে ভোক্তারা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নিয়মিত দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার তোয়াক্কা না করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে দিনের পর দিন চালায় দৌরাত্ম্য। অভিযোগ রয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক বলে খ্যাত সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো এলপিজিকে সুবিধা দিতেই নেওয়া হয়েছিল এ সিদ্ধান্ত।
শায়ানকে এলপিজির বাজার নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে একের পর এক চাপ প্রয়োগ করেছেন সালমান এফ রহমান। আর এর ফলে ভোক্তাদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নেয় বাপ-ছেলের এই সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির নামে ব্যাংক থেকেও মোটা অংকের ঋণ নেয় বেক্সিমকো এলপিজির নামে।
জানা যায়, গ্যাস সংকটের কথা উল্লেখ করে ২০০৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। পরে ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ চালু করা হলেও ২০১৪ সালের পর জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে। এরপর ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়।
কিন্তু খোদ জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেও সালমান এফ রহমানের চাপে বারবার আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের পুনঃসংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে বাধ্য হয় জ্বালানি বিভাগ। বর্তমানে সারা দেশে বেক্সিমকোর পাশাপাশি বসুন্ধরা, ওমেরা, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (ফ্রেশ), এস আলম গ্রুপ, জেএমআই গ্রুপ, সিটি গ্রুপের মতো শিল্প জায়ান্টসহ প্রায় ৩০টি অপারেটর এলপিজি ব্যবসা করছে।
এর বাইরেও ফ্রান্সের টোটালগ্যাস, ডাচ পেট্রোম্যাক্স এবং হংকংয়ের কাই হেং লং গ্লোবাল এনার্জির মতো বিদেশি অপারেটরগুলোও বাজারে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। ফলে গত এক দশকে দেশের এলপিজি বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে।
বাজার অপারেটররা জানান, ২০১৩ সালে এলপিজির চাহিদা ছিল ৮০ হাজার টন। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই চাহিদা ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ এক দশকের মধ্যে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে ১৫ গুণ। আর এটারই সুবিধা নিয়েছে বেক্সিমকো এলপিজি। স্বল্পসুদে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি সরকারকে চাপে রেখেছে আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ বন্ধ রাখতে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র তথ্যমতে, নথি অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে জনতা ব্যাংক মতিঝিলের দিলকুশা শাখা থেকে ৯৩টি ঋণপত্র বা বিক্রয় চুক্তির (এলসি/সেলস কন্ট্রাক্ট) বিপরীতে পণ্য রপ্তানি করেছেন এবং নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরেও রপ্তানি মূল্য প্রায় ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তারা দেশে আনেননি।
জানা যায়, জনতা ব্যাংকের বেশ পুরোনো গ্রাহক বেক্সিমকো গ্রুপ। গ্রুপটি ১৯৭৮ সালে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে। ১৯৯৮ সালে গ্রুপটির পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। এরপর বেক্সিমকোর টেক্সটাইল, এলপিজি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। ২০১৮ সালে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগ্রাসী অর্থায়ন করে।
ব্যাংকটির মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয় শাখা থেকে এই অর্থায়ন করা হয়, তখন শাখাটির ব্যবস্থাপক ছিলেন মিজানুর রহমান। তিনি এখন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।
জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে, দিয়েছে তার প্রায় ১৬ গুণ বেশি। যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকোর ঋণের ১৮ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে।
ফলে জনতা ব্যাংকের ঋণের ৫০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এমনকি এতে করে ব্যাংকটি তারল্য সংকটেও পড়ে যায়। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ১ ও ২ অনুকূলে ফান্ডেড ১ হাজার ২৩৪ ও নন-ফান্ডেড ৫৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন তারা। যার পুরোটাই বিদেশে পাচার হয়েছে।
র্তমান এলপিজি অপারেটরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্টোরেজ সক্ষমতা রয়েছে জেএমআই গ্রুপের ১৪ হাজার টন। স্টোরেজ সক্ষমতার দিক থেকে এরপরেই আছে বিএমআই এনার্জি (১০ হাজার ৭০০ টন), ওমেরা (৯ হাজার ৬০০ টন) এবং বসুন্ধরা (৯ হাজার ৩০০ টন)। যদিও বেক্সিমকো এলপিজি বরাবরই বলে আসছে তাদের এলপিজি স্টোরেজ সক্ষমতা পর্যাপ্ত। কিন্তু তার বাস্তবতা কোথাও পাওয়া যায়নি।
অস্থির বাজার: ২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। ওইদিন বিইআরসি কর্তৃক দর ঘোষণার সময় বলা হয় আমদানিনির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তি মূল্য ধরা হবে।
এরপর থেকে প্রতিমাসেই এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি। তবে বিইআরসির ঘোষিত দরে বাজারে পাওয়া নিয়ে অভিযোগ রয়েছে ভোক্তাদের। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, বাজারে নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যায় না এলপিজি সিলিন্ডার। বিক্রেতারা ইচ্ছামতো দর আদায় করেন। কমক্ষেত্রেই শাস্তির আওতায় আনার খবর আসছে।
অভিযোগ পাওয়া যায়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটা এলাকার খুচরা থেকে পাইকারি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রেতারা সিলিন্ডার প্রতি অন্তত ২ থেকে আড়াইশ টাকা বাড়তি আদায় করেন ক্রেতাদের কাছ থেকে। বিইআরসি নির্ধারিত দামের চাইতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয় একেকটি সিলিন্ডার।
দীর্ঘদিন ধরেই কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্যের চাইতে অনেক বেশি দাম আদায় করে নিচ্ছে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত এক একটি সিলিন্ডারে। বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করেই উৎপাদনকারী কোম্পানিসহ খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা ভোক্তাদের জিম্মি করে আদায় করছেন অতিরিক্ত অর্থ।
একেকটা সিলিন্ডার প্রতি ৩শ থেকে ৫শ’ টাকা বাড়তি আদায় করা যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন একে অপরকে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের এক জরিপে বলা হয়, এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাস কিনতেই ভোক্তাদের মাসে অন্তত ২১৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। সমন্বিতভাবে এই অর্থ লোপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে উৎপাদনকারী মিল, ডিলার এমনকি খুচরা বিক্রেতারা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের।
এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত খোদ বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা দর ঘোষণা করে দেই। আমদানিকারকদের সঙ্গে বসেই দর চূড়ান্ত করি। ব্যবসায়ীদের অবশ্যই নতুন দাম মেনে চলবে। এক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিশেষ করে খুচরা বিক্রেতাদের যাতে করে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে বাজার তদারকি করা মুশকিল। আমরা তো মাত্র কয়দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এ বিষয়ে আশা করি খুব দ্রুত কাজ শুরু করতে পারব। এক্ষেত্রে বাজার নজরদারির কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজির বাজার তো অনেক বড়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবাসিকে পুনঃ প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের গুজব: এদিকে সম্প্রতি সরকারের একটি অনির্দিষ্ট কোনো সূত্রের বরাত দিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, আবারও আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার।
যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা তিতাস। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিতাস জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ এবং লোড বৃদ্ধির সংযোগ বন্ধ রয়েছে।
সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তা সম্পূর্ণ গুজব ও ভিত্তিহীন। এতে আরও বলা হয়, কিছু প্রতারক চক্র জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তা থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। তা ছাড়া, প্রয়োজনে গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধও করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
পরিবর্তিত সরকারের কাছে সংযোগপ্রত্যাশিদের আহ্বান: তবে বিগত সরকার যে কারণেই হোক প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ বন্ধ রাখলেও পরিবর্তিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে গ্যাসের পুনঃসংযোগ পাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অনেক সাধারণ গ্রাহক।
তারা বলছেন, মূলত গুটিকয়েক এলপিজি ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষায় বিগত সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এতে করে কার্যত আবাসিকে গ্যাসের সংযোগ বৈধ উপায়ে বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ গ্রাহক অবৈধ উপায়ে সংযোগ নেয়। এ ছাড়াও প্রায় প্রতিটি পুরোনা গ্রাহকেরই বেড়েছে বার্নার সংখ্যা। এতে করে বিতরণ কোম্পানিগুলোও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিতে সমন্বয় সভায় কর্মকর্তা বলেন, দিনের পর দিন আবাসিক খাতে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও অভিযান চালিয়ে সবাই প্রায় ক্লান্ত।
কারণ, আবাসিক খাতে অনেক বাড়িতে অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা চিহ্নিত করা তিতাসের জন্য কঠিন কাজ। তবে গ্রাহকরা অবৈধভাবে ব্যবহার করতে চান না। বৈধ সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে বলেও দাবি করেন তারা।
জানা যায়, মোট গ্যাসের শতকরা ১২ শতাংশ ব্যবহার করা হয় আবাসিক খাতে। বাকিটা শিল্প ও অন্যান্য খাতে। অথচ প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আবাসিক খাতে অবৈধ ব্যবহার বন্ধের অভিযানে। অন্যদিকে শিল্পে হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ থাকলেও সেদিকে নজর কম দেওয়া হচ্ছে।
যা বলছেন মাঠ কর্মকর্তারা: নতুন সংযোগের বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বা বার্নার বর্ধিত করার অনুমোদন দিলে বিদ্যমান ব্যবহারের মধ্যেই শতকোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে। নতুন গ্যাস বরাদ্দের দরকার হবে না। গ্রাহকরা কেবল কাগজ-কলমে বৈধতা পাবে।
 

 
                            -20250402184141.webp) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন