শেখ পরিবারের অন্যতম সদস্য শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল। শেখ জুয়েল নামেই বেশি পরিচিত। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আপন চাচাতো ভাই। আওয়ামী লীগ তথা হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশের বিভিন্ন খাত ও রাজনৈতিক নেতাসহ সরকারি ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের কাছে তদবির-বাণিজ্যে ব্যস্ত ছিলেন জুয়েল।
সাধারণ মানুষ ও তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও যদি তার সঙ্গে যখন দেখা করতে যেতেন, তখন তিনি বলে উঠতেন, ‘টাকা আনছো, টাকা থাকলে দেখা করো না থাকলে যাও। আমরা রয়েল পরিবারের লোক রয়্যালিটি ছাড়া দেখা করি না, কথা বলি না।’ এমনিভাবেই নাকি হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাউদ্দিন সব সময় এসব কথা বলতেন। এসব কথা খোদ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই জানিয়েছেন।
শেখ সালাউদ্দিন ওরফে শেখ জুয়েলের ভাইদের নিয়েও রয়েছে অনেক অভিযোগ। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত অর্থপিপাসু মানুষ। অন্য ভাইয়েরা হলেন শেখ হেলাল, শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল। ফলে তার কাছে আসা প্রত্যেক মানুষের সঙ্গেই তিনি কোনো না কোনোভাবে টাকার কথা বলতেন। এ ছাড়া অন্য ভাইদের মধ্যে শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল ছিলেন সংসদ সদস্য। একই পরিবারের আরেকজন সংসদ সদস্য ছিলেন, শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়। তারা সবাই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করলেও খুলনায় এসে থাকতেন তাদের পৈতৃক বাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি হওয়ায় তাদের অনেক ঘনিষ্ঠজনরা সে বাড়িতে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, কেউ বা কোনো না কোনো কাজের উদ্দেশ্যে যেতেন। কিন্তু তাদের পৈতৃক এই বাড়িটিকে ঘিরে যেসব কার্যকলাপ হতো, তা কেবল মাফিয়া গডফাদারদের নিয়ে নির্মিত সিনেমাতেই দেখা যায়। একক শাসন আর ষড়যন্ত্রের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয় এই বাড়ি। আর এখান থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো বলে জানা গেছে। মূলত পদ্মার ওপারের আওয়ামী লীগের রাজত্বে যেন কেউ হানা দিতে না পারে ও বেঘাত ঘটাতে না পারে তার নীলনকশাই হতো এই বাড়িতে অবস্থান করা মাফিয়া গডফাদারদের ইশারায়।
জানা গেছে, খুলনা অঞ্চলের সব ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ, মনোনয়ন-বাণিজ্য, চাকরির নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু চলত এই বাড়ি ঘিরে। তখন সরকারি জনবল নিয়োগে ‘শেখ বাড়ির কোটা’ বলে একটা প্রথা চালু ছিল। হেলাল-জুয়েল কিংবা তার ভাইয়েরা কেউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে ছিলেন না। তবে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে হলে তাদের সমর্থন থাকতে হতো। দুর্নীতি-অনিয়ম, সন্ত্রাস, গুম, খুনসহ নানান অপকর্ম সবই হতো হাসিনার চাচাতো ভাইদের নির্দেশে। ওই এলাকার স্থানীয় সাধারণ মানুষরা ক্ষিপ্ত হয়ে বলছেন, কোথায় এখন শেখ পরিবারের সেই দাম্ভিকেরা। কোথায় তারা, যারা মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয় নাই, ঘুমাতে দেয় নাই। শেখ হাসিনার এত বয়ান আজ কোথায়? তার ভাই-ভাতিজাদের তো কোনো খবর নাই। দাম্ভিকতা দেখাইয়া তো পালাইয়া গেল। দাম্ভিকদের ক্ষমতার বড়াই, অহঙ্কার, দম্ভ নিমেষেই চূর্ণ হয়ে গেল। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গুহায় ঢুকে গেল। মানুষকে অশান্তিতে রেখে কোথায় আজ তারা? শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এ কথা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও বলছেন। শেখ পরিবার নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের একাধিক নেতা-কর্মী জানান, শেখ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাউদ্দিন ওরফে শেখ জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতে গেলেই তিনি টাকার কথা বলতেন। দলের বিভিন্ন কর্মসূচি বা কমিটির এবং দলীয় মনোনয়নসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে উনি শুরুতেই টাকার কথা বলতেন। বিভিন্ন সময়ে বলতেন যে, শেখ পরিবার রয়্যালিটিতে বিশ্বাসী। টাকা আনছো টাকা, টাকা থাকলে দেখা করো, না থাকলে যাও।
এ ছাড়া শেখ পাবিরারের সবাইকে দাম্ভিক বলেই জানত সর্বসাধারণ। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগে ‘রাঘববোয়াল’ নামেও পারিচিত ছিল তারা। এই দাম্ভিকদের চাপে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেশ কয়েকজন, উপদেষ্টামণ্ডলী সদস্য এবং দলটির যোগ্য ও ত্যাগী অনেক নেতাই কোণঠাসা ছিলেন। দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
দাম্ভিক আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা উল্লেখ করে দলটির নেতাকর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও দলের প্রয়োজনে কোনো ভূমিকা রাখেন না। তারা শুধু টাকার কথা চিন্তা করে সবসময় অর্থ আর দাম্ভিকতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে পতন হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ২০১৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী, শেখ জুয়েলের বার্ষিক আয় ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ। ২০২৩ সালে বার্ষিক আয় হয়েছে ৭ কোটি ২৮ লাখ ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কার্গো ও ফিশিং ট্রলার সম্পদ হিসেবে দেখালেও তাতে বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ করেননি। এর বাইরে বিদেশে অফশোর কোম্পানির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন।
গত ৪ ও ৫ আগস্ট কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর লাল প্রাচীরঘেরা খুলনা নগরের শেরেবাংলা রোডের দোতলা বাড়িটির অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। অথচ গত ১৬ বছরে এই বাড়ি হয়ে উঠেছিল খুলনা অঞ্চলের ‘সব ক্ষমতার’ কেন্দ্রবিন্দু। এই বাড়ির নির্দেশনায় চলত খুলনা অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সংগঠনের নেতারা নিয়মিত হাজিরা দিতেন এই বাড়িতে। বাড়িটি মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকত। বাড়ির সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত দামি গাড়ি। রাস্তায় থাকত পুলিশের সরব উপস্থিতি। জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও এই পরিবারের আশীর্বাদ নেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক ছিল।
শেখ পরিবারের পাঁচ ভাই, তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে রয়েছে শখানেক জাহাজ। ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপটি ছিল শেখ ভাইদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শেখ জুয়েল। ২০১৭ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শেখ সোহেল। কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন তাদের আরেক ভাই শেখ রুবেল। তারা ভোট ছাড়াই কেবল প্রভাব খাটিয়ে এসব পদ দখলে রেখেছিলেন। শেখ হাসিনার বিগত তিনটি পূর্ণ মেয়াদের সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা মনোনয়ন পাননি কেবল শেখ ভাইদের টাকা দেননি বলে। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদ থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যের মনোনয়নে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করত খুলনার শেখ বাড়ি। টাকার বিনিময়ে অনেককে শেখ ভাইয়েরা নৌকার মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে দেওয়া নৌকার প্রার্থী পছন্দ না হলে টাকার বিনিময়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী দাঁড় করাতেন তারা।
৫ আগস্টের আগে বা পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ জুয়েল। সম্প্রতি গণমাধ্যমে গুঞ্জন রটে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাউদ্দিন ওরফে শেখ জুয়েল ভারতে বিধান মল্লিক নাম দিয়ে ভারতে আধার কার্ড বাগিয়ে নেন। আধার কার্ডে বাবা শেখ আবু নাছের জায়গায় মুদিন্দ্রনাথ মল্লিক রাখেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাতিজার এমন কাণ্ডে রীতিমতো কপালে চোখ ওঠে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।
যদিও ফ্যাক্টওয়াচ জানায়, শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ জুয়েল ভারতে গিয়ে বিধান মল্লিক নামে আধার কার্ড নেওয়ার দাবিতে যে ছবিটি পাওয়া যাচ্ছে সেটির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
একাধিক সূত্র বলছে, শেখ জুয়েলের মতো শেখ পরিবারের অনেক সদস্যই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন বিশেষ প্রক্রিয়ায়। আধার কার্ডে শুধু নিজের নাম নয়, পাল্টে ফেলেছেন বাবার নামও। ওই কার্ড দিয়ে তারা ভারতে চলাফেরা করে আসছেন স্বাধীনভাবে। আবার ভারতে আশ্রয় নেওয়া অনেককে আবার ট্রাভেল কার্ডও দেওয়া হয়েছে। সেই কার্ড ব্যবহার করে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে পারছেন। তবে শেখ জুয়েল কলকাতাতেই বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছেন। তার বড় ভাই শেখ হেলাল, শেখ সোহেল এবং ছোট ভাই শেখ রুবেলও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাতেই অবস্থান করছেন।
২০১৮ সালে খুলনা-২ সংসদীয় আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শেখ সালাউদ্দিন। ২০২৪ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কাগজপত্রে তিনি শেখ সালাউদ্দিন হলেও সর্বত্র তিনি শেখ জুয়েল নামেই বেশি পরিচিত। গত ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পরপরই শেখ জুয়েলসহ শেখ পরিবারের প্রায় সবাই ভারতে আশ্রয় নেন। এর আগে শেখ পরিবারের অনেকেই ছিলেন সেনাবাহিনীর হেফাজতে। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সময়-সুযোগমতো তারা ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা হেফাজত থেকে বের হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান।
এদিকে, গত ২৪ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই খুলনা- ২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, শেখ সোহেল ও শেখ জালাল উদ্দিন রুবেল এবং ভাতিজা বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
আপনার মতামত লিখুন :