জয়পুরহাট জেলা সদরে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে মেসার্স রফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. রফিকুল আলম ও তার ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ আলী মজনুর বিরুদ্ধে। এসব করে ইতিমধ্যে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন মো. রফিকুল আলম।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রফিকুল আলম তার ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ আলী মজনুর মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ীকে ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও মাস্তান লেলিয়ে দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করলেও তার ভয়ে কেউ কিছু বলতে বা প্রতিবাদ করতে পারেননি।
ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে তিনি যা দাবি করেছেন, তা কড়ায়গণ্ডায় যেকোনো উপায়ে আদায় করেছেন।
হিসাবে গরমিল দেখিয়ে জয়পুরহাট জেলা সদরের রাহাত এন্টারপ্রাইজের কাছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বকেয়া উল্লেখ করে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোসহ বিভিন্ন সময়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও মাস্তান পাঠিয়ে নানা ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শনের কথা জানান ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. রমজান আলী।
এ বিষয়ে রাহাত এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. রমজান আলী বলেন, ‘মেসার্স রফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. রফিকুল আলমের সঙ্গে আমি ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে রড-সিমেন্টের ব্যাবসায়িক লেনদেন করে আসছিলাম এবং ২০২২ সালে সব দেনা-পাওনা পরিশোধ করে দিই। হঠাৎ করে ২০২২ সালের জুন মাসের ৯ তারিখে ৭ লাখ ১৭ হাজার ২৯০ টাকা বকেয়া দেখিয়ে আমাকে হালখাতার একটি চিঠি পাঠানো হয়।
হালখাতার চিঠি পাওয়ার পর আমি ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ আলী মজনুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে বলেন, আপনার বন্ধু এ অ্যান্ড জেড বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আসলাম হোসেনের কাছ থেকে পাওনা টাকা আপনাকে দিতে হবে। আর সেজন্যই আপনাকে হালখাতার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তখন আমি বলি, আপনাদের সঙ্গে আমার বন্ধুর লেনদেন বিষয়ে আমার তো কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই বা আমি তার জিম্মাদারও নই। তাহলে অন্যের পাওনা টাকা আমি কেন পরিশোধ করতে যাব? জবাবে ম্যানেজার মজনু আমার বন্ধুর বকেয়া টাকা তুলতে সহযোগিতা চাইলে আমি অপারগতা প্রকাশ করি। পরে ২০২৩ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২৯০ টাকা বকেয়া দেখিয়ে আমাকে আবারও হালখাতার একটি চিঠি দিলে আমি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তখন তিনি দেখা না করে আমার গ্রামের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে ভাড়াটে মাস্তান পাঠিয়ে দিয়ে নানা ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া শুরু করেন। নিরুপায় হয়ে আমি জয়পুরহাট ডিবি পুলিশের শরণাপন্ন হলে ডিবির একজন অফিসার ম্যানেজার মজনুর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার কাছে দাবি করা বকেয়া অর্থের হিসাব ও ডকুমেন্ট নিয়ে আসতে বললে তাতে তিনি কর্ণপাত করেননি।
পরবর্তী সময়ে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ম্যানেজার মজনু তার সঙ্গে তুহিন, সাদ্দাম, উজ্জ¦লসহ আমার বাসায় এলে মেহমানদারির একপর্যায়ে আমার শয়নকক্ষে ওয়ারড্রপের ওপর থেকে অস্বাক্ষরিত কয়েকটা চেকের পাতা চুরি করে নিয়ে যান। তার কিছুদিন পর আমাকে চেকের মামলার হুমকি দিলে হতভম্ভ হয়ে তাকে বলি, আমি তো আপনাকে কোনো চেক প্রদান করিনি, তাহলে চেকের মামলার ভয় দেখাচ্ছেন কেন? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সন্দেহ হলে আমার চেকবই বের করে দেখি, সেখান থেকে কয়েকটি পাতা তিনি যেদিন আমার বাড়িতে এসেছিলেন, তখনই চুরি করে নিয়ে গেছেন।
চেকের পাতা হারানোর বিষয়ে আমি জয়পুরহাট সদর থানায় গত ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট জিডি আবেদন করি। তখন থানায় কম্পিউটারের সমস্যা থাকায় ১৪ আগস্ট সেই জিডি পুলিশ আমলে নেয়। এ অবস্থায় ২০২৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বকেয়া।
জেলার জামালপুর ইউনিয়নের পীরপাড়া এলাকার সামছুল ইসলামের ছেলে মো. নাদিম মাহমুদ মুন্না নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, মেসার্স রফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সে আমি মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরিতে থাকাবস্থায় জামানত বাবদ আমার কাছ থেকে ২৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকা নেন ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. রফিকুল আলম ও তার ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ আলী মজনু।
অত:পর তার নির্দেশনা মোতাবেক আমার পিতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেসার্স আলহামদুলিল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সের নামে বিভিন্ন ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম রড ও সিমেন্ট বিক্রির রসিদের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে ‘মেসার্স রফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের ডিলার কোডে’ বিভিন্ন তারিখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মাধ্যমে জিপিএইচ ইস্পাত, বিএসআরএম, এসএস স্টিল, আবুল খায়ের স্টিল ও সালাম স্টিল বরাবর ৫৭ লাখ টাকা এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড থেকে ৭৭ লাখ টাকাসহ সর্বমোট ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রদান করার পর মো. রফিকুল আলম ও তার ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ আলী মজনুসহ তার লোকজন পরস্পর যোগসাজশে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা মূল্যের রড-সিমেন্ট উল্লেখিত কোম্পানি থেকে উত্তোলন করে নিজ হেফাজতে নেন। এরপর নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক তারা ক্রেতাদের রড-সিমেন্ট সরবরাহ না করলে ক্রেতারা আমাকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
এ ঘটনায় আমার বাবা সামছুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালত মামলা দুটির মধ্যে একটি সিআইডি, আরেকটি পিবিআই বরাবর তদন্তের আদেশ দেন। একপর্যায়ে রফিকুল আলম আপসের কথা বলে আমাদের ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মামলা তুলতে আমাকে বাধ্য করেন।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেসার্স রফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. রফিকুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কারণ তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধিতাকারী হিসেবে একাধিক মামলার আসামি হওয়ায় পলাতক রয়েছেন।
ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ আলী মজনুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে মেসার্স রফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী জানান, কিছুদিন আগে শাহ নেওয়াজ আলী মজনু চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও দেখা মেলেনি।
আপনার মতামত লিখুন :