বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে র্যাব ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার হাতে গুম হওয়া মানুষজনকে গোপন বন্দিশালায় নৃশংস নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
প্রতিবেদনটির নাম ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’, যা গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এতে ১,৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির বর্ণনা স্থান পেয়েছে।
২০১৭ সালে র্যাব-১০ এর হাতে ৩৯ দিন আটক থাকা এক তরুণ জানান, ‘মুখে গামছা দিয়ে জগভর্তি পানি ঢালা হতো। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। বারবার পানি দেওয়া হতো, অজ্ঞান হয়ে যেতাম।’
এই পদ্ধতি ‘ওয়াটারবোর্ডিং’ নামে পরিচিত। শ্বাসরোধ করে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল করে তথ্য আদায়ের প্রচেষ্টা ছিল এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। একে আন্তর্জাতিকভাবে অমানবিক নির্যাতন পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, তাদেরকে রাখা হতো ছোট, অন্ধকার ও অপরিচ্ছন্ন কক্ষে, যেখানে একই জায়গায় খাওয়া, ঘুমানো ও টয়লেট সারতে হতো। এমনকি টয়লেট ব্যবহারের সময়ও ক্যামেরা চালু থাকত, যা ছিল মারাত্মক অপমানজনক।
একজন বলেন, ‘শোবার সময় শরীর পড়ে থাকত প্যানের ওপর। সিসি ক্যামেরায় দেখা যেত সবকিছু। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম।’
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দুই ধরনের ঘূর্ণয়মান নির্যাতন যন্ত্র। র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে ব্যবহৃত চেয়ারে বসিয়ে দ্রুত গতিতে ঘোরানো হতো। কেউ বমি করতেন, কেউ প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলতেন। ডিজিএফআই-এর জেআইসি সেলে ব্যবহৃত হতো পুরো শরীর ঘোরানোর যন্ত্র, যাতে মানুষ শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে যেত।
২০১৮ সালে পুলিশের হাতে বন্দী এক নারী বলেন, ‘দুই হাত বেঁধে জানালার দিকে মুখ করে রাখত। গায়ে ওড়না না থাকায় পুরুষ কর্মকর্তারা দেখে হাসাহাসি করত।’
তিনি জানান, একবার এমন নির্যাতন করা হয় যে তার পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়, এবং প্যাড চাইলে তা নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়। এই অভিজ্ঞতাকে তিনি বর্ণনা করেছেন জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে।
এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘প্রস্রাব করার সময় হঠাৎ শরীর কাঁপে উঠত। মনে হতো পাঁচ ফুট ওপরে উঠে গেছি।’
এই বৈদ্যুতিক শক ছিল দ্বিতীয় সর্বাধিক নির্যাতন পদ্ধতি। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি গোপন সেল, গাড়ি কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে সহজেই ব্যবহার করা হতো।
এক ব্যক্তি জানান, ‘ঘুমাতে দিত না। শীতের মধ্যে কম্বল সরিয়ে দিত। মশা কামড়ালেও মারতে পারতাম না। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বসিয়ে রাখত।’ এই চর্চার লক্ষ্য ছিল বন্দীদের ঘুম বঞ্চিত করে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় প্রতিটি গুমের ঘটনার সঙ্গেই মারধর জড়িত ছিল। কেউ কেউ বলেন, মারধরের পরে ওষুধ বা মলম লাগিয়ে চিহ্ন লুকানো হতো, যাতে আদালতে বা জনসমক্ষে নির্যাতনের প্রমাণ না থাকে।
গুম থেকে ফিরে আসা অধিকাংশ ভুক্তভোগী মানসিক ট্রমা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন। কেউ কারও সাথে কথা বলেন না, কেউ একা একা হেসে ওঠেন।
একজন বাবা বলেন, ‘ছেলে ফিরে আসার পর স্বাভাবিক না। ওষুধ খেতে চায় না, উকিলের কাছে যাওয়া বাদ দিয়েছি। টাকা নেই।’
কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘গুমের নির্যাতন যতটা আমরা ভাবি, বাস্তবতা তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা প্রয়োগ করা হয়নি।’
আপনার মতামত লিখুন :