কুষ্টিয়ায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে ভয়ংকর তথ্য। ৫ আগস্টের পর দেশকে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে ভারতে অবস্থান করা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ছায়া সন্ত্রাসীদের ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের মধ্যে অনেকেই সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ভারতের বাহিনীগুলো সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নেওয়া সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিয়েছে। তারাই দেশে প্রবেশ করে জোটবদ্ধ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
গোয়েন্দা তথ্য মতে, পলাতক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ছত্রছায়ায় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দেশে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্যই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ অপরাধীদের ভূমিকা বেশি।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারীরা রাজধানীজুড়ে চাঁদাবাজি, দখল ও খুনের ঘটনায় জড়িত। এর বাইরে অনেকে জামিন নিয়ে ফের অপরাধে জড়িয়েছে। রাজধানীতে সম্প্রতি যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তার পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হাত রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে জানা যায়, শহরের পৌর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ সড়কে একটি তিনতলা বাড়ি। বাড়িটির মালিক মীর মহিউদ্দিন। বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন ছাত্র থাকেন। এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। দেড় মাস ধরে নিচতলায় ভাড়া থাকা সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সচরাচর বাইরে বের হতেন না। ছাত্ররা একজনকে দিনে দু-একবার শুধু খাবার খাওয়ার সময় বের হতে দেখেছেন।
কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দারা জানান, গতকাল ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত বাড়িটি ঘিরে রাখেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর কমপক্ষে পাঁচটি গাড়ি অভিযানে অংশ নেয় এবং বাড়ির নিচতলা ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালানো হয়।
রবিউল ইসলাম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ফজরের নামাজের সময় তিনি রাস্তায় সেনাবাহিনীর চারটি গাড়ি দেখতে পান। মীর মহিউদ্দিনের বাড়ি ঘিরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
জানতে চাইলে তারা জানান, ছাত্রদের মেসে অভিযান চলছে। এরপর ওই বাড়ি থেকে দুজনকে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গতকাল ভোরের দিকে বাড়ির তালা ভাঙার শব্দ পেয়ে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারা দেখতে পান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে অভিযান চালাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দুজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর গাড়িতে তোলা হয়। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা জানতে পারেন, এই বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সহযোগীরা। এর পর থেকে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ছাত্রাবাসে থাকা ইমন নামের এক শিক্ষার্থী জানান, ভোরের দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাত্রাবাসে এসে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করেন। একটি কক্ষের ভেতর ১৮ জনকে রেখে বলা হয়, অভিযান চলছে। এরপর নিচতলা থেকে দুজনকে নিয়ে যায়। সেই মেসের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, কয়েক দিন ধরে নিচতলায় এক দাড়িওয়ালা অপরিচিত ব্যক্তিকে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। তিনি দিনে একবার শুধু খাওয়ার সময় বাইরে বের হতেন। অভিযানের সময় সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দুটি কক্ষে বসিয়ে রাখেন এবং বারবার বলেন, তোমাদের কোনো ভয় নেই।
এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল্লাশি চলে। ৮টার কিছু সময় পর কালো মাইক্রোবাসটি একদম গেটের সামনে চলে আসে। নিচতলা থেকে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। এক ছাত্র কৌতূহলবশত জানতে চান কাকে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন একজন সেনা কর্মকর্তা তাদের বলেন, এখন বিস্তারিত বললে ভয় পাবা। পরে মিডিয়ায় দেখে নিয়ো। ছাত্রদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেসের পেছনের বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছিল।
মেসের বাসিন্দা এক ছাত্র বলেন, মালিকের কাছ থেকে পুরো বাড়িটি তারা ভাড়া নিয়েছেন। একজন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন। দেড় মাস আগে পেছনের বাড়ির বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী মিনারা খাতুন (হীরা) আসেন। তারা নিচতলার ফ্ল্যাট ভাড়া চান। তারা বলেন, এখানে অনলাইনে পোশাক কেনাবেচার জন্য পোশাক রাখা হবে এবং তাদের কিছু লোকজন থাকবেন।
মাসিক ছয় হাজার টাকায় ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেন ছাত্ররা। এরপর হেলাল উদ্দিন এই ভবনের সামনে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেন। ক্যামেরার সংযোগ পেছনে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। ভাড়া নেওয়ার কয়েক দিন পর এই বাসায় এক ব্যক্তি আসেন। তিনি দেখতে যুবক গোছের। খুব কম সময় বাসা থেকে বের হতেন। তবে তার সঙ্গে কখনো মেসে থাকা ছাত্রদের কথা হতো না। তার নাম-পরিচয় কেউ জানতেন না। ২০ থেকে ২৫ দিন আগে এক নারীকে নিচতলার এই ফ্ল্যাটে দেখতে পান ছাত্ররা। ওই নারী কিছুদিন এখানে অবস্থান করেন বলে ছাত্ররা জানান।
ছাত্ররা জানান, ১০-১২ দিন ধরে এই ভবনের সামনে একটি লাল রঙের প্রাইভেট কার এসে দাঁড়াত। বেশ কিছু লোকের যাতায়াত তারা লক্ষ করতেন। তবে কারও সঙ্গে ছাত্রদের কোনো কথা হতো না। নিচতলার যে ফ্ল্যাট থেকে সুব্রত বাইনকে আটক করা হয়েছে, ওই ফ্ল্যাটের ভেতরে গত দেড় মাসে কোনো রকম খাবার রান্না হয়নি। সব খাবার বাইরে থেকে আনা হতো।
সুব্রত বাইনকে যে ফ্ল্যাট থেকে আটক করা হয়েছে, ঠিক সেই ভবনের পেছনেই মিনারা খাতুন ও হেলাল উদ্দিনের বাড়ি। মিনারা একটি পোশাকের দোকানের মালিক। হেলাল উদ্দিন ১৭ থেকে ১৮ বছর দুবাই ছিলেন। গত বছরের শেষে বা চলতি বছরের প্রথমদিকে তিনি দেশে ফেরেন। হেলাল জমি কেনাবেচা ও ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যবসা করেন। দেড় মাস আগে স্ত্রী মিনারার মাধ্যমে সামনের ভবনের নিচতলাটা ভাড়া নেন। এরপর দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী নিচতলায় থাকতে শুরু করেন।
সুব্রত বাইনকে আটকের পর ভবনটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় থাকা ছাত্ররা বাড়ি চলে যাচ্ছেন। গতকাল দুপুরের পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮ জন ছাত্রের মধ্যে অধিকাংশ ব্যাগ নিয়ে যার যার বাড়ির চলে গেছেন। সেনাবাহিনীর অভিযানের পর থেকেই ছাত্ররা আতঙ্কে ছিলেন। এরপর দুপুরে যখন তারা নিশ্চিত হন যে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন তাদের এই নিচের ফ্ল্যাটে ছিল, তখনই তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ জন্য পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত তারা বাড়ি চলে যান।
আপনার মতামত লিখুন :