ফরিদপুরের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সদ্য নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পলাতক ঝর্ণা হাসানের নীলনকশায় সরকারি সম্পত্তি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এরই মধ্যে একাধিক পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রতিকারের জন্য একাধিক মামলা হলেও ‘অদৃশ্য শক্তির’ প্রভাবে ঝর্ণা হাসানকে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না।
বরং প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে মামলার বাদীদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি জমি ও বাড়ি দখলের জন্য ভারতীয় এক নাগরিককে এ দেশের নাগরিক সাজিয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি করে দখলের চেষ্টা করছেন এই আওয়ামী লীগ নেত্রী।
এ ঘটনায় সম্পত্তি ভোগদখলকারী ফরিদপুর শহরের কোতোয়ালি থানাধীন দক্ষিণ আলীপুরের বাসিন্দা অচিন্ত কুমার চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী গং ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে সম্প্রতি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় বিবাদী করা হয়েছে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), ফরিদপুর পৌরসভার তহশিলদার ও বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক দ্বৈত নাগরিককে।
জমির হাতবদল হয়ে বিক্রি করে যাতে ভারতীয় নাগরিক পালিয়ে যেতে না পারেন, তার জন্য একই আদালতে স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু চারটি ধার্য তারিখ পার হলেও আদালত থেকে কোনোপ্রকার নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
এরই মধ্যে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী লোকের মাধ্যমে ঝর্ণা হাসান ও বীরেশ চন্দ্র জমি ভরাট, বিভিন্ন ক্রেতার কাছে জমি দেখানোসহ ৫৪ বছর ধরে জমিতে বসবাসকারী কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবারকে উৎখাতের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ আলীপুরের ২২ শতাংশ জমি অর্পিত সম্পত্তি হলেও সেটিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। ২০০০ সালে ফরিদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকার সময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হাসিবুল হাসান লাভলু ওই জমি ও বাড়ি দখলের চেষ্টা করেন।
তিনি কাগজপত্র গায়েব করে দিয়ে নিজের নামে রেকর্ডও করে নেন। ২০০৮ সালে তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ঝর্ণা হাসান ওই জমির ওপর চোখ দেন। গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ঝর্ণা হাসান পলাতক।
কিন্তু পলাতক থেকেও বর্তমানে কলকাঠি নেড়ে বর্তমান জেলা প্রশাসনকে ব্যবহার করে ওই জমির দখলের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৫৪ বছর ধরে ওই জমির ওপর বাড়ি করে থাকা দুটি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানাধীন আলীপুর মৌজার আরএস ৫৬৯ নম্বর খতিয়ানভুক্ত আরএস ৩১২৭ নম্বর দাগের ২২ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দার।
তিনি স্বাধীনতার আগে সম্পত্তি রেখে ভারতে চলে যান। ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করায় এবং আর কখনো এ দেশে ফিরে না আসার সুযোগে দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দারের বাড়ির গৃহকর্মী ননীবালা দেবী এসএ রেকর্ডে তার নামে করে নেন জমিটি।
পরবর্তী সময়ে ফরিদপুরের ডেপুটি কমিশনার ননীবালা দেবীকে নালিশি সম্পত্তি কীভাবে নিজ নামে এসএ রেকর্ড করালেন সে জন্য কারণ দর্শানো ও দলিল-দস্তাবেজসহ তার কার্যালয়ে হাজির হতে নোটিশ দেন। ননীবালা ডেপুটি কমিশনের আদালতে হাজির হলেও এসএ রেকর্ড ননীবালার নামে করানোর পক্ষে কোনো কাগজপত্র বা উপযুক্ত দলিল-দস্তাবেজ হাজির করতে না পারায় ডেপুটি কমিশনার নালিশি সম্পত্তি বাবদ ননীবালা দেবীর নামীয় এসএ ৫৩২ নম্বর খতিয়ান কর্তন করে নালিশি জমিকে অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন।
পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হলে সরকার অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে অচিন্ত কুমার চক্রবর্তীর নামে ৫.২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য বাদী ও তাদের আত্মীয়দের নামে বাকি সম্পত্তি সরকার লিজ প্রদান করে। এর পর থেকে তারা খাজনা দিয়ে আসছেন। তারা ওই জমিতে বাড়িঘর তৈরি এবং বৃক্ষরোপণ করেন।
পরবর্তী সময়ে ননীবালা ওই সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি নয় ও নিজের সম্পত্তি দাবি করে ফরিদপুরের প্রথম সাব-জজ আদালতে দেঃ ৮৯/১৯৭৯ নং মোকদ্দমা দায়ের করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে আদালত মামলাটি ডিসমিস করে দেন।
পরে ননীবালা দেবী এ রায়ের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের জেলা জজ আদালতে আপিল মোকদ্দমা করলেও তিনি পরাজিত হন। পরবর্তী সময়ে ফরিদপুরের পৌরসভার চেয়ারম্যান হাসিবুল হাসান লাভলুর যোগসাজশে জরিপ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিয়ে ভারতের নাগরিক বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর নামে এ দেশের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে ননীবালা দেবীর মিথ্যা ওয়ারিশ সাজিয়ে ফরিদপুরে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ভুল বুঝিয়ে এসএ রেকর্ডীয় মালিকের ভুয়া ওয়ারিশ দেখিয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আদালত থেকে ডিক্রি লাভ করে। ডিক্রি পেয়ে এ সম্পত্তি বিক্রি করে বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য গত ২০ মার্চ সহকারী কমিশনার ভূমিকে এই সম্পত্তি বীরেশের নামে নামপত্তন না করতে নিষেধমূলক নিষেধাজ্ঞা প্রদান ও তদন্ত করে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বাদীরা প্রস্তাব করেন। কিন্তু সহকারী কমিশনার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বাদীরা আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন।
বাদীদের একজন সংবাদমাধ্যমকে জানান, ওই জমির মালিক ছিলেন দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দার নামের একজন। তিনি স্বাধীনতার আগে ভারতে চলে যান। পরে তার সম্পত্তি দেখাশোনা করেন তার কাজের মহিলা ননী বালা। জমি রেকর্ড করার সময় ননীবালা তার নামে এসএ রেকর্ড করে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালে জমিটি সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং বাদীদের কাছে লিজ দেয়। তিনি বলেন, ‘সরকারের জমি অন্য কেউ দখল করে নেবে সেটা মানব না। আমরা ৫৪ বছর ধরে সরকারি সম্পত্তি পাহারা দিচ্ছি।’
এই জমির বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, বর্ণিত জমিতে হাসিবুল হাসান লাভলু (বর্তমানে মৃত) সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদপুর পৌরসভা, ননী বালা দেবী কর্তৃক আম মোক্তার নিযুক্ত হন ও উক্ত জমি দীর্ঘদিন তার ভোগ দখলে ছিল এবং বর্তমানে তার ওয়ারিশদের ভোগ দখলে রয়েছে। ভিপি/হাল জরিপে বর্ণিত জমি হাসিবুল হাসান লাভলুর নামে রেকর্ড করা হয়। বর্ণিত জমি আদালতের রায়ে ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ মর্মে উল্লেখ করা হলেও উক্ত জমি কখনোই ভিপি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত ছিল না এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) আইন-২০১১ মোতাবেক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের ‘ক’ ও ‘খ’ তপশিলভুক্ত সম্পত্তি হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।
উল্লিখিত জমির মূল মালিক ১৯৬৫ সালে দেশত্যাগ করার কারণে তা ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ বা ‘নন রেসিডেন্ট প্রপার্টি’ বলে গণ্য হবে। উল্লিখিত জমি হাসিবুল হাসান লাভলুর (বর্তমানে মৃত) পক্ষে বর্তমানে তার ওয়ারিশদের নামে যেভাবে জরিপে রেকর্ড হয়েছে তা অবৈধ মর্মে প্রতীয়মান হয়।
এক বাদীর অভিযোগ, এসিল্যান্ড শফিকুল ইসলামের সঙ্গে ঝর্ণা হাসানের যোগসাজশে ভারতীয় নাগরিক বীরেশ চন্দ্রের নামে জমিটি নামজারির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার ধারণা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :