আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোরে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় সোনাতলা মসজিদের পাশের তিনতলা ভবন থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকেলে ইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকে।
এ সময় অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়।
এদিকে, সুব্রত বাইন গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। শীর্ষ এই সন্ত্রাসী কীভাবে গড়ে তুলেছিল তার সম্রাজ্য?
সূত্র জানায়, কিশোর বয়সে মগবাজারের একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলেন সুব্রত। সে সময় ১৯৯৩ সালের দিকে মধুবাজারে এক সবজিবিক্রেতা খুনের ঘটনায় পুলিশের তালিকায় তার নাম ওঠে তার।
এর কিছুদিন পর মগবাজারের ‘বিশাল সেন্টার’ নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। সেই থেকে সুব্রত বাইনের নাম গণমাধ্যমে আসতে শুরু হয়। পরে এই সন্ত্রাসী বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতাও হন বলে উল্লেখ আছে।
কথিত আছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ত্রাস ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। পুলিশের খাতায় তার পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর হাত ধরে মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে রাজধানীর হাজীপাড়া এলাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় রাজীব নামরে একজনকে।
এর ২৬ বছর পর হঠাৎ আলোচনায় আসে সেই রাজীব হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ঢাকায় আনাগোনা দেখে রাজীবের পরিবারও উদ্বিগ্ন। খিলগাঁও থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাজীবের ছিল প্যাকেজিং ব্যবসা।
এর আগেই অবশ্য ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় অপরাধ জগতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন। এ সময় মগবাজার এলাকায় কাজ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তখনকার বিএনপির শীর্ষ নেতারা তাকে ‘তারকা সন্ত্রাসী’র তকমাও দেয়।
এরপর থাকেই শুরু হয় তার অপরাধ জগতের মূল অধ্যায়- ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডার, মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজনের খুনের ঘটনায় নাম আসে সুব্রতর।
জানা যায়, ওই সময় রমনা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও মধুবাগ এলাকায় প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটত। তার বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৯১ সালে আগারগাঁওয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুরাদ খুনের ঘটনা। এ খুনের মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজাও হয়।
১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তার করেন। দেড় বছরের মতো জেলে থাকার পর তিনি জামিনে বের হন। সুব্রত জেলে থাকার সময় তার স্ত্রী লুসি গ্রুপেরই এক সদস্যের প্রেমে পড়েন। জেল থেকে বেরিয়ে ঘটনা জানার পর সুব্রত নিজেই লুসিকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। পরে ১৯৯৯ সালে কুমিল্লায় বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করলেও এর কয়েক বছর পর বিউটিকে ডিভোর্স দেন তিনি।
এদিকে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। সেই তালিকায় প্রথম নামই ছিল সুব্রত বাইনের। সে সময় তাকে ধরতে ইন্টারপোলেও নোটিশ দেওয়া হয়। কারণ ততদিনে দেশ ছেড়ে কলকাতায় ঘাঁটি গাঁড়েন তিনি। সেখানে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেখানে একটি মেয়ে আছে তার।
জানা যায়, ভারতে গিয়ে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য নথিপত্র তৈরি করেন সুব্রত। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ তাকে আটক করে। মামলায় অল্প দিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে দুবাই চলে যান।
দুবাই থেকে ফিরে কলকাতার এক চিত্রনায়িকার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সেই ফোনকলের সূত্রে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাকে ধরার চেষ্টা করলে সুব্রত নেপালের সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় ঢুকে পড়েন। পরে সেখানে নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। প্রথমে তাকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর এবং পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয়।
এদিকে, ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে ২০১২ সালে ঝুমকা কারাগার থেকে পালিয়ে যান তিনি। পরে ফের কলকাতায় আসার কয়েক দিন পর ২৭ নভেম্বর বউবাজার এলাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর কলকাতায় বসে ফতেহ আলী নামে ঢাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সুব্রত বাইন। এ সময় তিনি কলকাতায় গা-ঢাকা দিয়ে ফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়মিত চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।
জানা গেছে, ভারতে থেকে নেপালে গিয়েও নিজের নাম বদলে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন দীর্ঘদিন।
উল্লেখ, সুব্রত বাইনের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। তার জন্ম ১৯৬৭ সালে। বাবা বিপুল বাইন একটি এনজিওর গাড়ি চালাতেন। মায়ের নাম কুমুলিনি বাইন।
তিন বোন আর এক ভায়ের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। তিন মেয়েকে নিয়ে সুব্রতর মা ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন।
তিনি বরিশালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে তাকে ঢাকায় শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয় এবং সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেন।
এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর কলেজে আর ভর্তি হওয়া হয়নি তার।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                    -20251031190935.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন