জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন—‘কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’যেন ফুটবল মাঠের খেলোয়াড়দের মুখ ঢেকে কথা বলার দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি। মাঠে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির ফিসফিসানি বা কানে কানে গোপন আলাপ দর্শকদের মনে কৌতূহল জাগায়। কিন্তু এই গোপন কথার আড়ালে আসলে কী থাকে? কেন ফুটবলাররা মাঠে কথা বলার সময় মুখ আড়াল করেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে কৌশল, গোপনীয়তা এবং আধুনিক বিশ্বের ভাইরাল হওয়ার ভয় এই তিনের মিশ্রণ।
ফুটবল মাঠে খেলোয়াড়দের মুখে হাত দিয়ে কথা বলা একটি চেনা দৃশ্য। সতীর্থদের মধ্যে রণকৌশল নিয়ে আলোচনা, কোচ ও শিষ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা, দুই দলের খেলোয়াড়ের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় কিংবা রেফারির সঙ্গে কোনো বিষয়ে তর্কের সময় এই দৃশ্য প্রায়শই দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে এটি সাধারণ মনে হলেও, এর নেপথ্যে একাধিক কারণ বিদ্যমান।
প্রথমত, গোপনীয়তা রক্ষা করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। একজন কোচ যখন তার শিষ্যকে কোনো বিশেষ রণকৌশল বুঝিয়ে দেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না প্রতিপক্ষ দল সেটি শুনে ফেলুক বা ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে আঁচ করে নিক।
একইভাবে, কোনো খেলোয়াড় যখন রেফারির সঙ্গে কোনো বিষয়ে তর্কে লিপ্ত হন, তখন তিনি চান না সাংবাদিকরা তার কথা শুনে মুখরোচক খবর তৈরি করুক।
একসময় এই বিষয়গুলো নিয়ে তেমন মাথাব্যথা না থাকলেও, আধুনিক ফুটবলে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। টেলিভিশনের কল্যাণে যদিও এসব আলাপ সরাসরি শোনা যায় না, তবে ঠোঁট পড়ার (লিপ রিডিং) মাধ্যমে অনেক কিছুই জেনে ফেলা সম্ভব।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং প্রতিপক্ষ দল প্রায়শই লিপ রিডার নিয়োগ করে মাঠে বলা কথা উদ্ধার করার জন্য। আর এই কারণেই খেলোয়াড়রা কথা বলার সময় মুখের সামনে হাত রাখেন, যাতে মাঠের ভেতরের ও বাইরের কেউই তাদের কথোপকথন বুঝতে না পারে।
তবে শুধু গোপনীয়তা রক্ষাই মুখ ঢাকার একমাত্র কারণ নয়। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। গ্যালারির তীব্র কোলাহলের মধ্যে অনেক সময় খেলোয়াড়দের একে অপরের কথা শুনতে অসুবিধা হয়।
মুখে হাত দিয়ে কথা বললে শব্দ সরাসরি অন্যজনের কানে পৌঁছায় এবং কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট হয়। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর পিআর পরামর্শক ফিল হল এই তত্ত্বের সমর্থন করেছেন।
তিনি ২০১৭ সালে নাথান রেডমন্ডের সঙ্গে পেপ গার্দিওলার কথোপকথনের উদাহরণ টেনে এনে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এক ফুটবলারের বরাত দিয়ে তিনি জানান, মুখের কাছে হাত রাখলে কণ্ঠস্বর জোরালো হয়, যা কথা বুঝতে সাহায্য করে।
কোলাহলপূর্ণ স্টেডিয়ামে স্বাভাবিক কথা বলার সময় শব্দ ছড়িয়ে যায় এবং অস্পষ্ট শোনা যায়। কিন্তু মুখের ওপর হাত রেখে কথা বললে এবং হাতটি সঙ্গীর দিকে নির্দেশ করলে কথা অনেক স্পষ্ট হয়।
তবে এই যুক্তির বিপরীত মতও রয়েছে। ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক অধিনায়ক কাইল ওয়াকার মনে করেন, মুখ ঢাকার মূল কারণ হলো ক্যামেরার নজর এড়িয়ে যাওয়া।
তিনি বলেন, খেলোয়াড়রা হয়তো একে অপরকে গালিগালাজ করছে বা সামান্য ঠাট্টা-তামাশা করছে। আগের রাতে কোনো পার্টিতে দেখা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনেও হাসি-ঠাট্টা হতে পারে। ওয়াকার ঠোঁট পড়ার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেন।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখন এমন লোকও আছে যারা ঠোঁট পড়ে সব জেনে যায়। ২০২৩-২৪ মৌসুমে ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে ম্যাচে নিল মাউপের সঙ্গে তার বাদানুবাদ এবং লিপ রিডিংয়ের মাধ্যমে সেই হুমকির প্রকাশ হওয়ার ঘটনাটি এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
এই ঘটনার পর ফুটবল মাঠে কথোপকথনের গোপনীয়তা এবং লিপ রিডিংয়ের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একদিকে যেমন ফুটবলাররা ভাইরাল হওয়া বা শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে মুখ ঢাকছেন, তেমনই লিপ রিডাররা মাঠের ভেতরের গোপন খবর বের করে আনছেন।
তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, ফুটবল বিশ্বে লিপ রিডারদের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। মাঠে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকরা জানতে চান খেলোয়াড়রা আসলে কী বলেছিলেন।
অন্যদিকে, ফুটবলাররা নিজেদের বাঁচাতে মুখ ঢাকার কৌশল চালিয়ে যাচ্ছেন।