বিসিবির অধীনে ক্রিকেট যেন এক অদ্ভুত চক্রে আটকে পড়েছে। ঘরের মাঠে স্পিন সহায়ক ও মন্থর উইকেটে জয় আসছে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিশেষ করে বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে সেই সাফল্যের প্রতিফলন দেখা যায় না।
এর মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসছে মিরপুরের শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উইকেট। যে উইকেটকে দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে শুরু করে বিদেশি কোচ ও খেলোয়াড়রাও 'ব্যাটসম্যানদের কবরখানা' বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেই উইকেটই বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সমস্যাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে বিসিবির অলসতা এবং কিউরেটরের প্রতি তাদের অন্ধ বিশ্বাস।
কিউরেটর গামিনী ডি সিলভা ও বিসিবির রহস্যময় আস্থা
২০১৮ সালে কিউরেটর হিসেবে গামিনী ডি সিলভা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মিরপুরের উইকেটের অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, বরং তা আরও খারাপ হয়েছে।
৭ বছর ধরে একই ধরনের মন্থর ও স্পিন সহায়ক উইকেট তৈরি করা সত্ত্বেও বিসিবি তার প্রতি আস্থা রেখেছে। সম্প্রতি তার মেয়াদও বাড়াল বিসিবি।
বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে জানা গেছে, গামিনীর কাজের মানের চেয়ে উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে তার সুসম্পর্কই তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে।
ব্যাটিং প্রতিভার কফিনে শেষ পেরেক
মিরপুরের উইকেট শুধু ম্যাচ জেতার জন্য তৈরি হয় না, বরং এটি তরুণ ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাস ও ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়। দেশের তরকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাস এবং মেহেদী হাসান মিরাজরা বারবার বলেছেন, মিরপুরের উইকেটে ব্যাটিং করা কতটা কঠিন। এখানে রান করা তো দূরের কথা, টিকে থাকাই এক ধরনের যুদ্ধ।
তামিম ইকবালের মতে, এই উইকেটে খেলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ভালো উইকেটে খেলার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছে।
লিটন দাস বলেন, মিরপুরে অনুশীলন করলে ভালো হওয়ার চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
একজন প্রাক্তন টেস্ট অধিনায়কের মতে, এটি পিচ নয়, ব্যাটসম্যানদের কবরখানা।
যখন সাকিব, তামিম বা মুশফিকের মতো প্রতিষ্ঠিত তারকারা ভিন্ন উইকেটে রান করতে পারেন, তখন তরুণরা মিরপুরের উইকেটে সুযোগ পেলেই ব্যর্থ হচ্ছে।
কারণ এই উইকেট তাদের প্রতিভাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। ক্রিকেট বিশ্লেষকরাও বলেছেন, মিরপুরের পিচ ব্যাটসম্যান তৈরি করে না, বরং ধ্বংস করে।
ঘুম ভাঙলো বিসিবি কর্তাদের
সম্প্রতি, এই সমালোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছেন খোদ বিসিবির কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদিন ফাহিম মিরপুরের পিচকে 'অসন্তোষজনক' বলে স্বীকার করেছেন।
তিনি দাবি করেছেন, এই ধরনের পিচ তৈরির জন্য বোর্ড থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
তার মন্তব্যের পর, বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলও উইকেটের সমালোচনা করে বলেন, পিচ তৈরিতে ব্যবহৃত কালো মাটির কারণে ব্যাটসম্যানদের বল দেখতে সমস্যা হয়।
ফাহিমও তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ঘাস না থাকায় বল কালচে হয়ে যায়, যা ব্যাটসম্যানদের জন্য আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
তবে প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই সমস্যা সম্পর্কে কেন বিসিবি এতদিন নীরব ছিল? যখন প্রাক্তন ক্রিকেটার, বিদেশি কোচ এবং খেলোয়াড়রা বারবার অভিযোগ করে গেছেন, তখন কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
বিসিবি এখন এই সমস্যা স্বীকার করলেও, এর পেছনের কারণ এবং এর সমাধানে তারা কী পদক্ষেপ নেবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
মিরপুরের মাঠ নিয়ে বিদেশি তারকাদের হতাশা
শুধু দেশীয় ক্রিকেটাররাই নয়, বিদেশি কোচ ও খেলোয়াড়রাও মিরপুরের উইকেটের তীব্র সমালোচনা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন কোচ ড্যারেন লেহম্যান একবার বলেছিলেন, এখানে ক্রিকেট খেলতে পাঠানো মানে খেলোয়াড়দের শাস্তি দেওয়া।
বিপিএল এবং আন্তর্জাতিক সিরিজগুলোতে বিদেশি ব্যাটসম্যানরা বল ধরতে না পারায় চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন।
২০২১ সালে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারানোর পর সাকিব আল হাসান তখন বলেছিলেন, মিরপুরে কোনো ব্যাটসম্যানকে ১০-১৫টি ম্যাচ খেলানো হলে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে।
সম্প্রতি, পাকিস্তানকে ২-১ ব্যবধানে হারালেও, তাদের কোচ ও অধিনায়ক পিচের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
বিসিবির কাছে সমাধান কী?
মিরপুরের এই বিতর্কিত উইকেট এবং বিসিবির উদাসীনতা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎকে এক অনিশ্চিত পথে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্ব ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই ঘরের মাঠের উইকেটের ধরন পরিবর্তন করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :