রাজনৈতিতে মতপার্থক্যের কারণে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সম্পর্কে টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আগের মতোই গভীর হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতি তাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পুনব্যক্ত করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। কূটনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ফিলিস্তিনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে দখলদার ইসরায়েল।
এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ হলেও বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি বিবি নেতানিয়াহু। এখন পর্যন্ত অর্ধলাখ ফিলিস্তিনিকে নির্বিচারের হত্যা করেছে ইসরায়েল। পুরো ফিলিস্তিন যেন মৃত্যুপুরী, পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। তবুও ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সাহায্য অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কেন দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানাচ্ছে? এবং কখন থেকে এই সমর্থন শুরু করে?
শুরু থেকেই। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টির সময় প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি কে ট্রুম্যান যখন স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তড়িঘড়ি করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু কেন এত দ্রুত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেন তিনি? কিছুটা হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
ট্রুম্যানের সাবেক ব্যবসায়ী অংশীদার এডওয়ার্ড জ্যাকবসন ইসরায়েল রাষ্ট্রের মার্কিন স্বীকৃতি আদায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে কৌশলগত বিষয়ও যুক্তরাষ্ট্রকে এই সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী করে তুলেছে। কিন্তু এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল, তেমন নয়। প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ারের সময়ে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই শত্রুভাবাপন্ন।
বিশেষত ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ যুদ্ধ হয়, যেখানে মিশরের বিপক্ষে লড়াই করে ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ইসরায়েল মিশরের সিনাই উপদ্বীপ ও গাজার একটি অংশ দখল করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেওয়া আর্থিক সহায়তা বাতিল করার হুমকি দেয়। এরপর দীর্ঘদিন ইসরায়েলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আরও জোরদার করে এটিকে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে দুর্বল মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী। এই যুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনের বাকি ঐতিহাসিক জায়গা দখল করে নেয়। এর বাইরে সিরিয়া ও মিশরের কিছু অঞ্চলও দখল করে। মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই সংঘাত আরও তীব্র হলে স্নায়ুযুদ্ধ প্রক্সিযুদ্ধে পরিণত হতে পারত।
মধ্যপ্রাচ্য তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল; রয়েছে সুয়েজ খালের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এটাই বিশ্বশক্তিগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নামতে উৎসাহী করে তুলেছিল। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা ছিল, তারা আগেই তুলনামূলক দুর্বল হয়ে পড়া ইউরোপীয় শক্তিকে নিজের পক্ষে টেনে আনতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের কথা না বললেই নয়। সেই যুদ্ধে আবারও মিশর ও সিরিয়াকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী। এই যুদ্ধে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে মিশরকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় সেটা ব্যাহত হয়। যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তার সেই প্রচেষ্টা ১৯৭৯ সালে কিছুটা আলোর মুখ দেখে।
 
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মার্কিনিরা ইসরায়েলের পক্ষ নেয়। এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি রচনা করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কূটনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইসরায়েল তাদের কার্যকরী এক অস্ত্র হতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এই যুদ্ধে মার্কিনরা বেশ সফলতাও অর্জন করে এবং নিজেদের বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এমন একটি মিত্র দরকার, যারা তাদের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক দূরত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সেই সমস্যা নিরসনে শক্ত ঘাঁটি বিনির্মাণের জন্যই তারা বেছে নেয় ইসরায়েলকে।
যুক্তরাষ্ট্র তখন ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য তাদের হয়ে ফিলিস্তিনের সাথে দেনদরবার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসের কারণেই এখনো ইসরায়েল যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়।
বিগত তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলের একটি সুরাহা করার। তবে এক্ষেত্রে তাদের সমর্থনের পাল্লা তেলআবিবের দিকেই বেশি থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই ইসরায়েলের অনেক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে, যা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানেও।
২০২৩ সালে এসে গাজায় নৃশংস হামলার পরেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানাতে সেই দেশে ছুটে গেছেন। ব্লিঙ্কেন ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য পাচ্ছে ইসরায়েল। যা ২০২২ সালে ইসরায়েলের মোট সামরিক বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ।
তখন কী এমন কৌশলগত বিষয় ছিল?
আসলে এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই। তখন যুক্তরাষ্ট্র আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হচ্ছিল। সেসময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। তারা এই রাষ্ট্রটির প্রতি আরব বিশ্বের কোনো ধরনের মনোভাবকে তোয়াক্কা করে না।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্কও বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সৃষ্টির জন্য ইসরায়েল যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে এরপরও দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখান থেকে লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৮৫ সালে ইসরায়েলের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের হার অনেক বেড়েছে।
ইসরায়েলে থাকা মার্কিন দূতাবাসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দুই দেশ প্রায় ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে, যা থেকে সিংহভাগ লাভবান হয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরায়েল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। দেশটির বিভিন্ন রাজ্য ইহুদিপ্রধান দেশটির সাথে বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে, যা থেকে সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে তার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে। এর প্রতিদান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও কম দিচ্ছে না! এছাড়াও আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে।
এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এদের মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হলেন জুইশ কমিউনিটির মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনে আমেরিকান ইজরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-এর অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

 
                             
                                    -20250406173810.webp)





 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন