মোসাদ হল ইসরায়েলের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা, যা মূলত বৈদেশিক গোয়েন্দাবৃত্তি, বিশেষ অভিযান এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরেই এটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রহস্যজনক ঘটনা বা গুপ্ত হামলার পেছনে প্রায়ই মোসাদের নাম উঠে আসে, যার ফলে প্রশ্ন দেখা দেয়- ‘সব রহস্যের পেছনে কি সত্যিই মোসাদের হাত আছে?’
ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের কিছুদিন পরেই ১৯৪৯ সালে মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েল এমন একটি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল,তারা ভাবতো আশেপাশের দেশগুলো তাদের শত্রু। ফলে একটি শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন ছিল, যা বৈশ্বিক পরিসরে ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে।
বলা হয়, মোসাদের অপারেশনের অধিকাংশই চরম গোপনীয়তার মধ্যে পরিচালিত হয়। কখন, কোথায়, কীভাবে তারা কাজ করে তা জানা প্রায় অসম্ভব। এই অদৃশ্যতা তাদের মিশনকে সফল এবং শত্রুপক্ষের জন্য বিভ্রান্তিকর করে তোলে।
মোসাদ হামাস, হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে বহু গোপন অভিযান পরিচালনা করেছে। শত্রু নেতাদের হত্যা, অপহরণ বা নজরদারির মতো জটিল কাজ মোসাদ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করে থাকে।
ইসরায়েলের এই সংগঠনের কার্যক্রম এতটাই গোপনীয় যে বিশ্বব্যাপী নানা রাজনৈতিক বা সামরিক ঘটনার সঙ্গে সংস্থাটির সম্পৃক্ততা নিয়ে অনেক সময় সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অনেক কন্সপিরেসি থিওরি বিশ্বাস করে, আন্তর্জাতিক অনেক হত্যাকাণ্ড বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে মোসাদ কাজ করেছে, বিশেষ করে যখন তা ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক।
গত শুক্রবার (১৩ মে) ভোররাতে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং শীর্ষ কমান্ডার ও বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে ‘রাইজিং লায়ন’ নামের নিখুঁত এক গোপন অভিযান চালায় ইসরায়েল। অভিযানে ইরানের বিপ্লবী গার্ড কোরের প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এবং পদার্থবিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহদি তেহরাঞ্চিসহ বহু শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি নিহত হন।
ইরানের হামলার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, ইরানের এই হামলা মোসাদের নেতৃত্বে দীর্ঘ বছর ধরে পরিকল্পিত ও প্রস্তুত বহুস্তরবিশিষ্ট একটি হামলা।
সংবাদমাধ্যম বলছে, এই অভিযান শুরু হয় ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদের ছদ্মবেশী সশস্ত্র কমান্ডো দল ও বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন দ্বারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা দিয়ে, পরে তা পর্যায়ক্রমে সামরিক ও বিমান হামলায় রূপ নেয়।
মোসাদের আলোচিত কয়েকটি গোপন মিশনগুলো...
১. অপারেশন এনতেবি (১৯৭৬)
১৯৭৬ সালের ২৭ জুন, এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমান উগান্ডার এনতেবি বিমানবন্দরে জিম্মি করা হয়। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন (PFLP) এবং জার্মান রেভল্যুশনারি সেলসের সদস্যরা এই ঘটনার নেপথ্যে ছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি।
মোসাদের ভূমিকা: ইসরায়েল থেকে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এনতেবি বিমানবন্দরে মোসাদ এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (IDF) কমান্ডোরা এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান পরিচালনা করে। মাত্র ৯০ মিনিটের এই অভিযানে সব জিম্মিকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। এই অভিযানে ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ভাই ইয়োনাথান নেতানিয়াহু শহীদ হন।
২. অপারেশন ওয়ার্থ অব গড (প্রতিশোধ অভিযান) (১৯৭২–১৯৮৮)
১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী দল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ১১ জন ইসরায়েলি অলিম্পিক খেলোয়াড়কে জিম্মি করে হত্যা করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে মোসাদ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একটি গোপন অভিযান চালায়।
মোসাদের ভূমিকা: মোসাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে এবং অত্যন্ত গোপনে তাদের নির্মূল করে।
৩. পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের নির্মূল (২০১০–বর্তমান)
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘদিনের উদ্বেগের কারণ। ইরান যখন গোপনে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে, তখন ইসরায়েল এই কর্মসূচি বন্ধ করতে বিভিন্ন গোপন অভিযান পরিচালনা করে।
মোসাদের ভূমিকা: মোসাদ একের পর এক ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা, গাড়িতে বিস্ফোরণ অথবা দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ব্যবহার করে নির্মূল করে। ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিযাদেহকে তেহরানের কাছে এক অত্যাধুনিক রিমোট-কন্ট্রোলড মেশিনগানের মাধ্যমে হত্যা করা হয়, যা মোসাদের অভিযানের একটি চাঞ্চল্যকর উদাহরণ।
৪. অপারেশন ফিনাল ফোরস (অ্যাডলফ আইকম্যান অপহরণ) (১৯৬০)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ ইহুদি হত্যার পরিকল্পনাকারী এবং হলোকাস্টের অন্যতম প্রধান স্থপতি অ্যাডলফ আইকম্যান যুদ্ধ শেষে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় আত্মগোপন করেন।
মোসাদের ভূমিকা: মোসাদ একটি গোপন অভিযান চালিয়ে আইকম্যানকে শনাক্ত করে এবং ১৯৬০ সালে তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে আসে।
৫. অপারেশন ডায়মন্ড (যুদ্ধবিমান চুরি) (১৯৬৬)
১৯৬৬ সালে মোসাদ ইরাকের কাছ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মিত অত্যাধুনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান হাতে পাওয়ার পরিকল্পনা করে, যা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত প্রযুক্তির অন্যতম সেরা যুদ্ধবিমান।
মোসাদের ভূমিকা: মোসাদ একজন ইরাকি পাইলটকে রাজি করিয়ে তার যুদ্ধবিমানসহ ইসরায়েলে পালিয়ে আসতে সহায়তা করে।
৬. অপারেশন অর্চার্ড (সিরিয়ার গোপন পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস) (২০০৭)
২০০৭ সালে সিরিয়ার দেইর এজ-জোর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত এলাকায় উত্তর কোরিয়া ও সিরিয়ার যৌথ উদ্যোগে একটি গোপন পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করা হচ্ছিল।
মোসাদের ভূমিকা: মোসাদ গুপ্তচর এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এই চুল্লির অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী সেই স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়ে সেটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।
৭. ইরানের গোপন পরমাণু দলিল চুরি (২০১৮)
২০১৮ সালে মোসাদ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে একটি বিশাল আকারের গোপন নথি চুরি করার সাহসী অভিযান চালায়। এই নথিগুলো ইরানের তেহরানের একটি সুরক্ষিত গুদামে সংরক্ষিত ছিল।
মোসাদের ভূমিকা: মোসাদের এজেন্টরা এক রাতে ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে শত শত নথি, সঞ্চিত তথ্য এবং নকশা চুরি করে ইসরায়েলে নিয়ে আসে।
আপনার মতামত লিখুন :