ভেনেজুয়েলা আবারও যুক্তরাষ্ট্রের নজরে রয়েছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার নতুন নামকরণ করা যুদ্ধ বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার)। তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি ২০১৫ সাল থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে। তবে এবার পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠছে। ট্রাম্পের লক্ষ্য শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং সরাসরি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। তার ভাষায়, ‘দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে এখন বিদায় নিতে হবে’।
২০১৭ সালের আগস্টে প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট থাকাকালেই ট্রাম্প প্রকাশ্যে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এসে তার ভাষা আরও আক্রমণাত্মক হয়েছে। সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোও আসন্ন সামরিক অভিযানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত আগস্ট মাসে ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরোর মাথার দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫০ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। চলতি মাসে আরও একধাপ এগিয়ে ট্রাম্প সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি)-কে ভেনেজুয়েলার ভেতরে গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। এর পাশাপাশি পুয়ের্তো রিকোতে এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বি-১ ও বি-৫২ বোমারু বিমান এবং বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড নামের বিশাল রণতরীও ওই অঞ্চলের দিকে পাঠানো হয়েছে।
সেপ্টেম্বর থেকে মার্কিন বাহিনী ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরে মাদকবাহী জাহাজের বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি বিমান হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, কলম্বিয়ান ও ভেনেজুয়েলান কার্টেলগুলোর জাহাজ ধ্বংস করা হয়েছে, বিশেষ করে কার্টেল দে লস সোলস ও ট্রেন দে আরাগুয়া নামের গোষ্ঠীগুলোর।

ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি ত্রিনিদাদ ও টোবাগো দ্বীপে ইতোমধ্যে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস গ্রেভলি মোতায়েন হয়েছে। বর্তমানে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সাতটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ অবস্থান করছে, আর ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড স্ট্রাইক গ্রুপ পৌঁছালে সেই সংখ্যা ঠেকবে ১০-এরও বেশি, যা ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় মোতায়েন মার্কিন নৌবহরের চেয়েও বড়।
গ্রেনাডা (১৯৮৩), পানামা (১৯৮৯) ও ইরাক (২০০৩)—এই তিনটি দেশেই ওয়াশিংটন প্রায় একই কৌশলে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করেছিল। কেউ ছিল মার্কসবাদী, কেউ আবার ছিল একসময় সিআইএ-সমর্থিত হলেও পরে আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামরিক অভিযানের পর কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার পরিবর্তন ঘটে।
তেলসমৃদ্ধ ইরাক শাসনকারী সাদ্দাম হোসেনকে ২০০৩ সালে মার্কিন-যুক্তরাজ্য জোট উৎখাত করেছিল। এবার টার্গেটে ভেনেজুয়েলা। দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম তেল মজুদকারী অর্থাৎ ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল। আয়তন ইরাকের দ্বিগুণ এবং ভারতের রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র মিলিয়ে প্রায় সমান।
বিশ্বের বৃহত্তম যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড বর্তমানে আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে। ৯০ হাজার টনের এই রণতরী আগামী ১০ দিনের মধ্যে ভেনেজুয়েলার উপকূলে পৌঁছাতে পারে। এর বহরে রয়েছে এমন বিমানসংখ্যা, যা ভেনেজুয়েলার পুরো বিমানবাহিনীর প্রায় দ্বিগুণ।
আগামী সপ্তাহগুলোতে ভেনেজুয়েলার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট নিয়ে আলোচনা চলছে।
প্রথম সম্ভাবনা হলো যুদ্ধ ছাড়াই শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন। এতে মাদুরোর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে লক্ষ্য করে হত্যা বা অপসারণ করা হতে পারে, এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সুযোগ তৈরি করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। এমন হলে মাদুরো হয় নির্বাসনে যাবেন, নয়তো লুকিয়ে পড়বেন দেশের জঙ্গলে বা বিদেশে, সম্ভবত চীন বা রাশিয়ায়।

তবে এই পথ সহজ নয়। ভেনেজুয়েলায় সিরিয়ার মতো শক্তিশালী বিদ্রোহী সংগঠন নেই। কলম্বিয়ার সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীরা মাদক ব্যবসা ও খনিজ পাচারেই বেশি সক্রিয়। ফলে মাদুরো সরকারের অভ্যন্তরীণ পতনের সম্ভাবনা সীমিত।
দ্বিতীয় দৃশ্যপটে দেখা যেতে পারে সীমিত পরিসরের সামরিক হামলা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আক্রমণ না করে বিমান হামলা ও চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে মাদুরোকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবে। নভেম্বরের শুরুতেই ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড ও পাঁচটি আর্লে বার্ক শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার ভেনেজুয়েলার উপকূলে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দেবে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা ও একাধিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান।
মাদুরো যদি এই চাপের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেন, তবে ওয়াশিংটন মিশন সম্পন্ন ঘোষণা করে বাহিনী প্রত্যাহার করতে পারে।
তৃতীয় ও সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দৃশ্য হলো পূর্ণাঙ্গ মার্কিন সামরিক আক্রমণ। মাদুরো যদি ট্রাম্পের হুমকি উপেক্ষা করেন, তবে ওয়াশিংটনের হাতে থাকবে সরাসরি সামরিক আগ্রাসনের বিকল্প। বাস্তবতা হলো ভেনেজুয়েলার সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনায় অতি নগণ্য। তাদের হাতে আছে কয়েকটি পুরোনো এফ-১৬ ও রাশিয়ান সু-৩০ যুদ্ধবিমান; কার্যকর কোনো সাবমেরিন নেই, আর নৌবহরও বেশ দুর্বল। প্রায় ১ লাখ সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ সদস্যই সক্রিয় নয়।
তবুও পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রাম্প এখনো গর্ব করে বলেন, তিনি ২১ শতকে একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু করেননি এবং তার সেই অবস্থান নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গেও জড়িত।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভেনেজুয়েলায় সরাসরি আক্রমণের মতো পর্যাপ্ত সৈন্য নেই, মাত্র আড়াই হাজার মেরিন সেনা। তবে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যান্ড করপোরেশনের মতে, প্রয়োজনে ৫০ হাজার সেনা পর্যন্ত মোতায়েন করা সম্ভব। কলম্বিয়া ও গায়ানা সীমান্ত থেকে হামলা চালিয়ে রাজধানী কারাকাসে প্রবেশের পরিকল্পনাও যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারে।
অন্যদিকে, মাদুরো প্রচলিত যুদ্ধের চেয়ে গেরিলা-ধাঁচের প্রতিরোধে বেশি জোর দিচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যে সরকারি কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে গঠিত প্রায় ৪০ লাখ স্বেচ্ছাসেবক বিশিষ্ট ‘বলিভারিয়ান মিলিশিয়া’ সক্রিয় করেছেন। তাদের লক্ষ্য যেকোনো মার্কিন আগ্রাসনকে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল যুদ্ধে পরিণত করা।
ভেনেজুয়েলার জঙ্গল, পাহাড় ও ওরিনোকো নদীর ব-দ্বীপ এমন একটি ভূপ্রকৃতি তৈরি করেছে, যা মার্কিন বাহিনীর জন্য ইরাকের মতো এক নতুন ‘জলাভূমি’তে রূপ নিতে পারে। তা ছাড়া মার্কিন জনগণের আরেকটি আঞ্চলিক যুদ্ধে আগ্রহ কমে যাওয়াও বড় প্রতিবন্ধক। সব মিলিয়ে, ভেনেজুয়েলায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এখনো সম্ভাবনার পর্যায়ে থাকলেও উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ওয়াশিংটনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে—তা শুধু লাতিন আমেরিকাই নয়, পুরো বিশ্বের কূটনৈতিক অঙ্গনে এখন নজরকাড়া প্রশ্ন।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে





সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন