বাংলাদেশে এখন এক নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মানবিক করিডোর। এটি মূলত যুদ্ধ বা সংকটপূর্ণ এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি রাস্তা। অনেক সময় এই পথ দিয়ে খাবার, ওষুধ এবং চিকিৎসা সহায়তাও পৌঁছানো হয়। তবে প্রশ্ন উঠছে- এই করিডোর আদৌ কি সবার জন্য ভালো নাকি রয়েছে ঝুঁকি?
মানবিক করিডোরের অসুবিধা
# অস্ত্র ও মাদক পাচারের ঝুঁকি- করিডোর অনেক সময় নিয়ন্ত্রণহীন থাকে। এই ফাঁকে অপরাধী চক্র অস্ত্র ও মাদক পাচার করতে পারে।
# সন্ত্রাসীদের চলাচলের সুযোগ- সাধারণ মানুষের সঙ্গে সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থিরা করিডোর ব্যবহার করে গা ঢাকা দিতে পারে।
# অর্থনৈতিক চাপ- আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা সবকিছুর জন্য সরকারের অতিরিক্ত খরচ হয়। এতে সাধারণ জনগণের ওপর চাপ পড়ে।
# জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট- নতুন মানুষ এলে কর্মসংস্থান, জমি, পানি ও বিদ্যুৎ নিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ে।
# সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিরোধ- ভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে স্থানীয়দের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি ও দ্বন্দ্ব হতে পারে।
# স্থায়ী সমস্যায় রূপ নেয়- প্রথমে বলা হয় অস্থায়ী, পরে দেখা যায় তারা ফিরে যায় না। ফলে দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সংকট তৈরি হয়।
# রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা- আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে যায়। দেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হতে পারে।

মানবিক করিডোরের সুবিধা
# মানবজীবন রক্ষা- মানবিক করিডোরের সবচেয়ে বড় উপকার হলো নিরীহ মানুষদের প্রাণ বাঁচে। যুদ্ধ, সহিংসতা বা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
# আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জন- মানবিক করিডোর চালু করলে বিশ্ব বাংলাদেশকে মানবিক ও সহানুভূতিশীল দেশ হিসেবে দেখে। এতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
# পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক- যুদ্ধ বা সংকটে বিশৃঙ্খলা এড়াতে করিডোর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষ গোপনে পালিয়ে না গিয়ে নিয়ম মেনে নিরাপদে সরতে পারে।
# চিকিৎসা ও সাহায্য পৌঁছানো সহজ হয়- আহত বা অসুস্থদের দ্রুত চিকিৎসা দেয়া যায়। খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহও সহজ হয়।
# জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় তৈরি হয়- এতে ভবিষ্যতে সহায়তা পাওয়া, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প আনার সুযোগ বাড়ে।
বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা কেন?
বর্তমানে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি মানবিক করিডোর খোলা হোক। বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে এই প্রস্তাব উঠেছে। বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য এটি দরকার।
কিন্তু এ প্রস্তাবে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এমনিতেই বেশি। ইতিমধ্যে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে আমাদের দেশে। মানবিক করিডোর খুললে নতুন করে আরও লোক আসতে শুরু করবে। এতে দেশের ওপর চাপ বাড়বে- চাকরি, চিকিৎসা, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই।
তবে, সঠিকভাবে পরিচালনা করলে কিছু উপকার হতেও পারে। অসহায় মানুষ বাঁচতে পারে। তবে এটি চালাতে হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ দরকার।
যদিও, রোববার (৪ মে) রাজধানীতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) খালেদুল রহমান জানান যে, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর চালুর বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আলোচনা বা চুক্তি হয়নি।

বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর খোলা কতটা ঠিক?
বাংলাদেশ বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত। অর্থনৈতিক চাপ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, আর দীর্ঘমেয়াদি রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ। এমন সময়ে মানবিক করিডোর চালু করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই স্পর্শকাতর।
প্রথমেই বোঝা দরকার, এ করিডোর কাদের জন্য খোলা হচ্ছে?
যদি এটি হয় সীমান্তের ওপার থেকে আসা মানুষদের জন্য, তাহলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড, নিরাপত্তা এবং সম্পদের ওপর আবারও বড় চাপ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গা উপস্থিতির কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এরইমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মানবিক করিডোর খুললে সেই অভিজ্ঞতা আবার নতুন করে ফিরে আসতে পারে- এমন আশঙ্কা বাংলাদেশের জন্য মোটেই অমূলক নয়। অনেক সময় বিদেশি সংস্থাগুলো করিডোর চালুর প্রস্তাব দেয় মানবিকতার নামে, কিন্তু বাস্তবে এই উদ্যোগের দায়ভার অনেকটাই পড়ে সংশ্লিষ্ট দেশের ওপর।
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। তাই একদিকে যদি মানবিক দায়িত্ব থাকে, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপত্তা। মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত অস্থির। সেই অঞ্চল থেকে কেউ এলে তারা কোন পরিচয়ে আসছে, সেটা নির্ণয় করা কঠিন।
কেউ হয়তো নিরীহ, আবার কেউ হতে পারে অস্ত্রধারী বা অপরাধী। এই যাচাই-বাছাই ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দিলে নিরাপত্তার বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও চিন্তা করলে, বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক ঋণ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট মোকাবিলা করছে। এই অবস্থায় নতুন করে আরও মানুষকে আশ্রয় দেওয়া শুধু কঠিনই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিও হতে পারে।
তবে এমন সিদ্ধান্তে একেবারে না বলাও উচিত নয়। যদি করিডোর হয় সীমিত আকারে, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক সহায়তার ভিত্তিতে, তাহলে উভয় দেশের উপকার হতে পারে। তবে সেটি হতে হবে সময়সীমা নির্ধারিত, স্বচ্ছ এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর চালু করা শুধুমাত্র মানবিক নয়, এটি একটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক সিদ্ধান্ত। তাই আবেগ নয়, প্রয়োজন বাস্তবতা বুঝে ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করা। ছোট ভুল বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :