ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫

অক্টোবরে পাকিস্তানে হামলার পরিকল্পনা ভারত-ইসরায়েলের!

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২৫, ০৮:১৩ পিএম
ছবি- এআই দিয়ে তৈরি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানা ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হলেও এই সংঘাতের ছায়া এখন অন্যদিকে পড়ছে, লক্ষ্য পাকিস্তান। সাম্প্রতিক নানা তথ্য ও বিশ্লেষণে ইঙ্গিত মিলছে, ইসরায়েল ও ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে।

এখন আর অজানা নয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র।

মার্কিন প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল-ভারত ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবাদিক হোস্টাইল হোমল্যান্ডস বইয়ের লেখিকা আজাদ এসা মনে করেন, ইসরায়েল ও ভারতের এই সম্পর্ক শুধুই কূটনৈতিক নয়, বরং এর গভীরে রয়েছে মুসলিমবিরোধী একটি মতাদর্শিক যোগসূত্র।

তিনি বলেন, ‘মোদি ও নেতানিয়াহুর মিত্রতা কেবল দুই নেতার নয়, এটি দুটি রাজনৈতিক চেতনার মেলবন্ধন অর্থাৎ ইসরায়েলের ‘ইহুদিবাদ’ ও ভারতের ‘হিন্দুত্ববাদ’।

আজাদ এসা নিজে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন অঞ্চলে গিয়ে পরিস্থিতি দেখেছেন। তার মতে, দুই দেশের সামরিক বাহিনী একই ধরনের দমনমূলক কৌশল অনুসরণ করছে।

মোদির রাজনৈতিক আদর্শ অনেকাংশেই ইসরায়েলি নীতিমালা থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি ২০১৭ সালে ইসরায়েল সফর করেন। এটাই ছিল কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ইসরায়েল ভ্রমণ।

এমনকি ভারতের অনেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রকাশ্যে বলছেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ইসরায়েলের মডেল অনুসরণ করে করতে হবে, যেমন ফিলিস্তিনে ইসরায়েল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে বসতি গড়ছে, তেমনি কাশ্মীরেও হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব উঠছে।

২০২৫ সালের মে মাসে পাকিস্তানের কাছে একটি বড় কূটনৈতিক বা সামরিক পরাজয়ের পর, ভারত নতুন করে ইসরায়েলসহ বহু পশ্চিমা দেশ থেকে গোপনে বিপুল অস্ত্র সংগ্রহ করছে।

এসব পদক্ষেপ স্পষ্ট করে যে ভারত ও ইসরায়েল এখন একত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই নতুন হুমকি শুধু কথার কথা নয়, এটি এখন বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে বলেও মনে করেন পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট হামিদ মীর।

এখন ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের সহযোগিতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধের সময় পাকিস্তান প্রকাশ্যে ইরানকে সমর্থন করেছিল, এতে অনেক ইসরায়েলি ক্ষুব্ধ। এই অবস্থাকে কেন্দ্র করে ভারত-ইসরায়েল জোটের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী পরিকল্পনার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

যুদ্ধ চলাকালে ১৮ জুন ইসরায়েলি ভূরাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী মেইর মাসরি সোশ্যাল মিডিয়া এক্স-এ আরবি ভাষায় লেখেন, ‘ইরানের হামলার পর, আমরা পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার চেষ্টা করতে পারি।’

তার এই বক্তব্য পাকিস্তানিদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একই সময়ে অনেক ভারতীয় অ্যাকাউন্টও এই ধরনের হুমকি ছড়াতে থাকে।

ভারতীয় পোস্টে দেখা গেছে, ‘পাকিস্তানকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করা হচ্ছে, এটাই ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর শেষ ধাপ।’

এই হুমকির ভাষা কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ইউরোপের একটি ওয়েবসাইট মর্ডান ডিপ্লোম্যাসি গত ২৪ জুন কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক ড. জুলিয়ান স্পেন্সার-চার্চিলের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘ইসরায়েল যদি ইরানকে পরাজিত করে, তবে পরবর্তী লক্ষ্য পাকিস্তান’।

নিবন্ধের শুরুতেই তিনি মেইর মাসরির হুমকির উদ্ধৃতি দেন এবং লেখেন, ইরানকে দুর্বল করার পর ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য হবে পাকিস্তান।

তার মতে, ভারতকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ইসরায়েল পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাবে ভারতীয় সেনা অভিযান চালিয়ে দেশটিকে টুকরা টুকরা করার চেষ্টা হতে পারে এবং আজাদ কাশ্মীর দখলের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশ পথ বন্ধ করা হতে পারে, অর্থাৎ গোয়াদর বন্দরকে বিচ্ছিন্ন করা ইসরায়েল-ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য।

অস্ত্র বাণিজ্য ও যৌথ পরিকল্পনা

ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক অস্ত্র চুক্তিগুলোও এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি ভারতে কারখানা খুলেছে। শুধু ক্ষেপণাস্ত্র নয়, তারা ভারতে ড্রোনও তৈরি করছে।

২০১৮ সালে ভারতের আদানি গ্রুপ ও ইসরায়েলের এলবিট সিস্টেম একসঙ্গে মিলে হায়দরাবাদে একটি কারখানা গড়ে তোলে, যেখানে হার্মিস ৯০০ নামের সামরিক ড্রোন তৈরি হয়।

এই ড্রোনগুলোর ৮৫ শতাংশ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য তৈরি হয় এবং ইসরায়েল এগুলো লেবানন ও গাজায় ব্যবহার করেছে। ইরানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক যুদ্ধে এই ড্রোনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।

২০২৫ সালের মে মাসে ভারত এই একই ড্রোন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেও পাকিস্তান সেগুলো সফলভাবে প্রতিরোধ করার দাবি করেছে। তবে ইরান হাইফা বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আদানি গ্রুপের যে অংশীদারিত্ব ছিল, তার অনেকটাই ধ্বংস করে দেয়। হাইফা বন্দরের ৭০ শতাংশ মালিকানা আদানির হাতে।

জিও নিউজের এক প্রবন্ধে হামিদ মীর লেখেন, ‘ভারত ও ইসরায়েল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পরিকল্পনা করতে পারে, কিন্তু তাদের বুঝে নেওয়া উচিত পাকিস্তান লেবানন, গাজা বা ইরান নয়। নয়াদিল্লি ও তেল আবিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নরেন্দ্র মোদির জন্য শেষ পর্যন্ত অপমানের কারণও হয়ে উঠতে পারে। এখন অনেকেই তাকে ‘আত্মসমর্পণকারী মোদি’ বলে ডাকছে।’

২০২৫ সালের মে মাসে পাকিস্তান বিমান বাহিনী সাতটি ভারতীয় যুদ্ধবিমানসহ চারটি রাফায়েল ভূপাতিত করে। পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের চেয়েও অনেক শক্তিশালী। আর পাকিস্তানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের চেয়েও বেশি কার্যকর ও বিপজ্জনক বলে তার দাবি।

সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে পাকিস্তান প্রকাশ্যে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আর ভারত ইসরায়েলের পক্ষে ছিল। ভারতের নীতি স্পষ্ট, গাজায় গণহত্যা হোক বা ইরানে হামলা, ভারত সবসময় ইসরায়েলকে সমর্থন করে। কারণ ভারতের দৃষ্টিতে ইসরায়েলকে সমর্থন করাই জাতীয় স্বার্থ।

মোদি এখন ইসরায়েলের সহযোগিতায় পাকিস্তানে হামলার পরিকল্পনা করছেন, কারণ তিনি কাশ্মীরকে আরেকটি গাজা বানাতে চান। এমনকি ভারতপন্থি কাশ্মীরি রাজনীতিক ফারুক আবদুল্লাহ পর্যন্ত বলেছেন, যদি ভারত আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না করে, তাহলে কাশ্মীর গাজার মতো হয়ে উঠতে পারে।

২০২৫ সালের অক্টোবরের বিহার নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় দেখাতে চান। আর তাই হয়তো কাশ্মীরে দমন-পীড়ন অথবা সরাসরি যুদ্ধ; সবই তার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হয়ে উঠছে। ভারত-ইসরায়েল যৌথ পরিকল্পনায় আগামী অক্টোবরে পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারে বলে দাবি করেছেন তিনি।

তবে কাশ্মীরকে ভারত ও ইসরায়েলের আরেকটি ‘গাজায় পরিণত করার পরিকল্পনা’ পাকিস্তান বাস্তবায়ন করতে দেবে কি না, সেটা এখন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সম্ভবত উত্তর না-ই হবে। আর যদি সেটাই হয়, তাহলে ত্রি-দেশীয় সম্ভাব্য সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ায় যে ভয়াবহতা তৈরি করবে, তা অনুমেয়।

খবর ছড়িয়েছে সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর এ নিয়ে সিনেমা তৈরির কাজ শুরু করেছে নয়াদিল্লি। বলিউড সিনেমায় ভারত হয়তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলও হচ্ছে।

আঞ্চলিক এই দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে যেকোনো সংঘাতের ফলে গোটা অঞ্চল অস্থিরতায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! এ আশঙ্কার বাস্তবতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে দক্ষিণ এশিয়ায়।