ঢাকা রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

বিবিসির প্রতিবেদন

উৎসবের রং কি ফিকে হবে সংকটের মুখে?

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৫, ১১:২৭ এএম
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের বার্ষিকী উদযাপনের সময় রাজধানী আনন্দে ভরে ওঠে। ছবি- সংগৃহীত

এক বছর আগে এই সময়েই উত্তাল ছিল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের বর্ষপূর্তিতে চলতি সপ্তাহে ঢাকার রাজপথে নেমেছিল হাজারো মানুষ। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এক নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, উন্মোচন করেছেন ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার পরিকল্পনা।

রোববার (১০ আগস্ট) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশজুড়ে কনসার্ট, সমাবেশ এবং বিশেষ প্রার্থনার মাধ্যমে এই দিনটিকে অনেকে ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করে উদযাপন করছেন।

কিন্তু এই আনন্দঘন দৃশ্যগুলো গত ১২ মাসের পুরো গল্পটি বলেনি। এই উৎসবের চিত্রের আড়ালেই রয়েছে এক জটিল বাস্তবতা। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, গত এক বছরে গণপিটুনি, প্রতিশোধমূলক হামলা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের মতো ঘটনা বেড়েছে, যা গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

নারীর অধিকারে বিতর্ক

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার সরকারের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং ভিন্নমতের ওপর নৃশংস দমনের অভিযোগ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করে।

এর মধ্যে নারী অধিকার কর্মী শিরিন হকের নেতৃত্বে গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন অন্যতম। এই কমিশন চলতি বছরের এপ্রিলে লিঙ্গ সমতার পক্ষে বেশকিছু যুগান্তকারী সুপারিশ করে। এর মধ্যে উত্তরাধিকার ও বিবাহবিচ্ছেদে নারীর সমান অধিকার, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো ছিল।

ছবি- সংগৃহীত

কিন্তু পরের মাসেই এই সুপারিশের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে হাজার হাজার ইসলামপন্থি। হেফাজত-ই-ইসলামের মতো সংগঠনগুলো এই প্রস্তাবকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করে এবং নারী কমিশন ভেঙে দেওয়ার দাবি জানায়। তাদের মতে, ‘নারী-পুরুষ কখনো সমান হতে পারে না’। এই চাপের মুখে কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আর বিস্তারিত জনবিতর্ক হয়নি।

শিরিন হক বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, বিপ্লব নয়। নারীবিদ্বেষ এবং পুরুষের আধিপত্য আগের মতোই অটুট রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম যখন আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে আমরা যথেষ্ট সমর্থন পাইনি, যা আমাকে হতাশ করেছে।’ ইউনূসের কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

অতীতের প্রতিশোধ ও বর্তমানের সংকট

বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনার শাসনামলে কোণঠাসা হয়ে থাকা কট্টরপন্থি দলগুলো এখন নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে। তারা মেয়েদের ফুটবল খেলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছে এবং পোশাকের কারণে নারীদের হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। শুধু তাই নয়, গত এক বছরে সুফি মুসলিমদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়েও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

একদিকে যেমন হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে, তেমনই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের মতে, ‘বাংলাদেশে এমন এক বিশাল জনগোষ্ঠী আছে যারা কেবল জবাবদিহিতা নয়, প্রতিশোধও দেখতে চেয়েছিল।’

তবে হাসিনার দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ করছে যে, গত এক বছরে তাদের শত শত সমর্থককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সমালোচকদের মতে, এই হত্যাকাণ্ডগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না এবং অনেককে শুধু পূর্বের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আটক করে রাখা হয়েছে।

এভাবেই উৎসবের আড়ালে এক নতুন বাংলাদেশ তার অতীত ও বর্তমানের সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। একদিকে যেমন নতুন দিনের স্বপ্ন, তেমনই অন্যদিকে প্রতিশোধের রাজনীতি ও উগ্রবাদের উত্থানের আশঙ্কা দেশটির ভবিষ্যৎকে এক অনিশ্চিত পথের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

অর্থনীতিতে স্বস্তি, রাজনীতিতে প্রশ্ন

এই ক্রান্তিকালে কিছু ইতিবাচক দিকও দৃশ্যমান। অনেকেই দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে দেশের ব্যাংকিং খাত টিকে আছে। রেমিট্যান্স এবং আন্তর্জাতিক ঋণের ওপর ভর করে বাংলাদেশ তার ঋণের বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে পেরেছে। খাদ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের একটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে। রপ্তানি খাতও স্থিতিশীল।

ড. ইউনূসের সঙ্গে শিরিন হকসহ নারী অধিকার কর্মীরা। ছবি- সংগৃহীত

অর্থনৈতিক অর্জনের পাশাপাশি একটি বড় পরিবর্তন হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের মতে, ‘একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এখন সবাই স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে।’ যে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেখানে এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রাপ্তি।

কর্তৃত্ববাদের নতুন শঙ্কা

তবে এই অর্জনের পাশাপাশি রয়ে গেছে বড় উদ্বেগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ছাত্রনেতাদের প্রভাব নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। সমালোচকদের মতে, আওয়ামী লীগের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মতো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছাত্রদের চাপের মুখেই নেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘সরকার মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের কিছু জনপ্রিয় দাবি মেনে নিয়েছে, কারণ তারা আরও ভয়াবহ বিক্ষোভের আশঙ্কা করেছিল।’

অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করছেন, তাদের সমর্থকদের পরিকল্পিতভাবে রাজনীতির বাইরে রাখা হচ্ছে। দলের বেশির ভাগ নেতা নির্বাসিত বা কারাগারে থাকায় আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বিবিসিকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনই অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।’

এই রাজনৈতিক বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর মতো ঘটনা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি জনতার সহিংসতা বা গণপিটুনি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করেছি, কিন্তু পুরোনো কর্তৃত্ববাদী আচরণের অবসান না হলে আমরা সত্যিই একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে পারব না।’

বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আগামী ছয় মাস দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি শাসনব্যবস্থায় সত্যিকারের পরিবর্তন আনা না যায়, তবে এই গণঅভ্যুত্থানে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের সেই আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।