ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বৌদ্ধধর্মই কী সংঘাতের কারণ?

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০৯:১০ পিএম
ছবি- আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স

সম্প্রতি ৯০তম জন্মদিন পালন করেছেন তিব্বতের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা দালাই লামা। তিনি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, পরবর্তী ১৫তম দালাই লামার উত্তরাধিকারী বাছাই করবেন। এই ঘোষণা চীনের তীব্র অসন্তোষের কারণ হয়েছে। অন্যদিকে ভারত দালাই লামার পাশে থেকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে।

দালাই লামার উত্তরাধিকার নির্বাচন নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং হিমালয়ের ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে। চীন তিব্বত ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে চায়, বিশেষ করে দুর্বল তিব্বতের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য। অপরদিকে ভারত চাইছে, এই প্রভাব চীনের দখলে যেন না যায়।

তিব্বতের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা দালাই লামা দালাই লামা। সম্প্রতি পেরিয়েছেন ৯০তম জন্মদিন। তার উত্তরাধিকারী তিনিই বাছবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন এই ধর্মগুরু। যা চীনের অপছন্দ। এদিকে দালাই লামার পাশে রয়েছে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই যারা তিব্বত ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ভারত-চীন দ্বন্দ্বের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন, তাদের মনে প্রশ্নটা আসবেই- এখানে ভারত ও চীনের কী ভূমিকা? একজন ধর্মগুরুর উত্তরাধিকারী বেছে নেওয়ায় দু’টি রাষ্ট্রের কী ভূমিকা থাকতে পারে?

আসলে ভারত ও চীনের মধ্যে হিমালয়ের বৌদ্ধধর্মের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার এই প্রবণতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দালাই লামা। এটা কিন্তু কেবলই বাণিজ্য কিংবা ভূখণ্ড দখলের চেনা কোনও কূটনৈতিক লড়াই নয়। এখানে কেন্দ্রবিন্দুতে ধর্ম। চীন চায় তিব্বতের দুর্বল পরিকাঠামোর সুযোগে ধর্মীয় দিক থেকে এখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে। সোজা কথায় প্রভাব বিস্তার করে রাখতে। অর্থাৎ ‘দাদাগিরি’ করতে। তিব্বতে যত বেশি দৃঢ় হবে চীনের মুষ্ঠি, ততই নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়বে। কাজেই আর সেটা হতে দিতে চায় না ভারত।

অথচ ভেবে দেখলে বৌদ্ধধর্ম অহিংসার কথাই তো বলে এসেছে। কিন্তু এই ধর্মই কী করে যেন ভূ-রাজনৈতিক দাবাখেলার এক বোর্ড করে তুলেছে তিব্বতকে। ধ্যান ও ধর্মীয় শিক্ষার আকর হিসেবে পরিচিত মনাস্ট্রিগুলোই যেন জাতীয়তাবাদী খেলার ‘পাওয়ার গেম’-এর আখড়া। লাদাখ, তাওয়াং এমনকি নির্জন ভুটান পর্যন্ত বৌদ্ধ সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমানতা এক বৃহত্তর কৌশলের অংশ। কিন্তু এর কেন্দ্রে নিশ্চিতভাবেই তিব্বত ও দালাই লামা।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ গুরু দালাই লামাকে বেছে নেওয়া শুরু হয় ১৩৯১ সালে। অর্থাৎ ৬০০ বছরেরও বেশি সময়ের আগে। কিন্তু সোনাম গেতসোর সময় দালাই লামার পদে বসার সময় থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতিকরণ হতে থাকে সেই পদটির। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তিও প্রথম হয়। তারপর যত সময় এগিয়েছে তত রাজনীতি ধীরে ধীরে তার অবস্থান মজবুত করেছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে তা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধে। সেই সময় কার্যতই টগবগিয়ে ফুটছে তিব্বত।

১৯৫১ সালে ‘১৭ দফার চুক্তি’ হয়েছিল, যার অন্যতম শর্তই ছিল তিব্বতের ধর্মীয় স্বশাসন। তার আগে ১৯৫০ সালেই তিব্বত চলে গিয়েছে চীনের দখলে। কাজেই বোঝা যাচ্ছিল এই ‘স্বশাসন’ আসলে একটা ‘বিভ্রম’ মাত্র। ফলে চুক্তি ঘিরে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েই ছিল। লাসায় টহল দিচ্ছিল চীনা সৈন্যরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সমঝোতায় আসতে চাইছিলেন দালাই লামা। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা গেল।

১৯৫৯ সালে পরিস্থিতি কার্যতই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তিব্বতের মানুষ ভয় পাচ্ছিলেন। তাদের ভয় ছিল হয়তো তাদের ধর্মীয় নেতাকে অপহরণ করা হবে। হয়তো হত্যাই করে ফেলবে চীন! ততদিনে চীর মুষ্ঠি ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠেছে তিব্বতে। এরপরই দালাই লামার সিদ্ধান্ত ছেড়ে চলে যেতে হবে তিব্বত। দু’সপ্তাহ লেগেছিল ভারতে পৌঁছাতে। ৩১ মার্চ হিমাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়েই ভারতে প্রবেশ করেন দালাই লামা। তাকে গ্রহণ করেন আসাম রাইফেলসের সেনারা। পেছনে পড়ে রইল তার জন্মভূমি। চীনের কারণে আর যেখানে ফিরে যাওয়া হয়নি তার।

এরপর থেকেই তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত করতে শুরু করে চীন। প্রথমেই লামাদের আরও বেশি করে প্রান্তিক করে দেওয়া হতে থাকে। তারা যেন কোনোভাবেই রাষ্ট্রের বিপক্ষে মুখ খুলতে না পারে তা নিশ্চিত করা হতে থাকে। বহু বৌদ্ধ সংগঠনকে সরাসরি একরকম দখলই করে ফেলে বেইজিং। মনাস্ট্রিগুলোর কার্যক্রম অত্যন্ত নিবিড়ভাবে নজরে রাখা শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক দশকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ২০০৭ সালে রীতিমতো আইন করে চীন জানিয়ে দেয়, তারা স্বীকৃতি না দিলে এখানে কোনো বৌদ্ধ ধর্মগুরুই স্বীকৃত বলে গণ্য হবেন না।

উলটো দিকে দালাই লামা ভারতে প্রবেশের পরও কিন্তু নয়াদিল্লি এর কোনো অনৈতিক ফায়দা নেওয়ার সুযোগ পায়নি। চীনের বজ্রমুষ্ঠিই শক্ত হয়েছে তিব্বতে। কার্যতই বাধ্য হয়ে গত দশক থেকে ধীরে ধীরে ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ভারতের ‘স্বদেশ দর্শন’ প্রকল্পের। যা ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প।

দেশটির পর্যটনের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তোলাই প্রকল্পটির লক্ষ্য বলে প্রচার করা হয়েছে। কুশীনগর, সারনাথ ও গোয়ার মতো ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলোকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলাও যারই একটি অংশ। পাশাপাশি বৌদ্ধ যে ভারতেই জন্মেছিলেন, তিনি যে আদতে ভারতীয়- সে কথাই তুলে ধরার কৌশল নিয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু এই ধরনের ‘নরম’ পদক্ষেপের বেশি যায়নি নয়াদিল্লি। অন্যদিকে চীন রীতিমতো রাষ্ট্রশক্তি জোরাল করেছে বৌদ্ধধর্মের উপরে। বলাই বাহুল্য, ‘পাখির চোখ’ সেক্ষেত্রে তিব্বতই। ফলে প্রসঙ্গতই এসে পড়ছে দালাই লামার নাম।

বর্তমান দালাই লামা জানিয়েছেন, তিনিই বেছে নেবেন ১৫তম ধর্মগুরু। সম্প্রতি ধরমশালায় এক ধর্মসম্মেলনে তিনি এমন ঘোষণা করেছেন। আর এতেই প্রমাদ গুনেছে চিন। তাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ (এমনকি ‘সন্ন্যাসীর বেশে নেকড়ে’) ট্যাগ দিয়ে বেইজিংয়ের সাফ কথা, তাদের দেশের ধর্মাচরণ থেকে ঐতিহাসিক প্রথা মেনেই বাছতে হবে উত্তরাধিকারী। সোজা কথায় দালাই লামার মনোনয়নের জন্য তাদের অনুমোদন লাগবে। এই দাবি নস্যাৎ করে দেয় নয়াদিল্লি। ভারত সরকারের স্পষ্ট বার্তা, নির্ধারিত ট্রাস্ট ছাড়া অন্য কারও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।

এহেন মন্তব্যের পরই এবার পালটা আক্রমণ করে বেইজিং। তাদের দাবি, নয়াদিল্লি যেন চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলায়। এতে দুই দেশের সম্পর্কেই প্রভাব পড়বে। জবাবে চুপ থাকেনি ভারতও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, ‘যারা দালাই লামার অনুসারী, তারা সকলেই জানেন, নির্ধারিত সংগঠনই তার উত্তরসূরি বাছাই করবেন। তিনি এবং সেই ট্রাস্ট ছাড়া অন্য আর কারও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।’ এই ‘অন্য কারও’ বলতে তিনি কাদের কথা বলছেন তা সহজেই বোঝা যায়।

যাইহোক, পরিস্থিতি যা তাতে কিন্তু ‘অ্যাডভান্টেজে’ ভারত না কি চীন, তা এখনো ধোঁয়াশায়। তবে নয়াদিল্লির দাবি তারাই ‘রাইট ট্র্যাকে’ রয়েছে। কেননা বৌদ্ধধর্মের ‘প্রাণভোমরা’ রয়েছেন ভারতেই। পরবর্তী দালাই লামাও ভারত থেকেই নির্ধারণ হবে। ফলে দালাই লামার প্রতি চীনের রক্তচক্ষু ভারতের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠছে।

তথ্যসূত্র: সংবাদ প্রতিদিন