ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫

ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত, এরপর কী?

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৫, ১০:৫৯ পিএম
হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচল করছে। ছবি- সংগৃহীত

১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত ট্যাংকার নরম্যান আটলান্টিক হরমুজ প্রণালিতে ইরানের একটি বন্দুকবাজের আক্রমণের পর আগুনে পুড়ে যায়। পরের বছর এপ্রিলে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনীর ইউএসএস স্যামুয়েল বি. রবার্টস (এফএফজি-৫৮) হরমুজ প্রণালির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় একটি নৌ মাইনের কবলে পড়ে।

এতে জাহাজের ভেতরে একটা বিরাট গর্ত হয়ে গেল। প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন বাহিনী আরব উপসাগরে ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে ‘অপারেশন প্রেয়িং ম্যান্টিস’ চালু করে।

ইরানের পাল্টামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছে। এখন শুধু দেশটির সুপ্রিম কাউন্সিলের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ‘শীঘ্রই’ সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

একদিকে ইরান, অন্যদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যেই বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রণালি থেকে সরে যাচ্ছে। সংকীর্ণ এই জলপ্রবাহ দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল (প্রায় ১৭-২০ মিলিয়ন ব্যারেল) পরিবহন করে, যার মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

ইরানের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। সোমবার (২৩ জুন) বিশ্বব্যাপী বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ৭৭ দশমিক ৩৬ ডলারে পৌঁছেছে। ডব্লিউটিআই বেড়ে ৭৪ দশমিক ১৫ ডলারে পৌঁছেছে। তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতির আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারগুলোতেও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। সূচকের পতন বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।

এই ক্ষুদ্র জলরাশির এত গুরুত্ব কেন?

হরমুজ প্রণালির কোলঘেষেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরান। এবং এটি ‘সরু দরজাও’ বটে। অনেকটা বাড়িওয়ালার হুমকির মতো যে, সে বিশ্বের তেল সরবরাহের সদর দরজা বন্ধ করে দেবে। আর এখন তারা বলছে, ‘ইরান পারে’। উপকূলজুড়ে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তেহরানের। 

ইরানের কি এই প্রণালি বন্ধ করার আইনি অধিকার আছে?

না। শুধু ইরান কেন, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্ররই সেই অধিকার বা আইনি বৈধতা নেই। কারণ এটি মানবসভ্যতার জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন অনুসারে, কোনো দেশেরই একতরফাভাবে প্রণালি বন্ধ করার আইনি অধিকার নেই।

সামুদ্রিক যান চলাচল কীভাবে চলে?

যদিও প্রণালিটি তুলনামূলকভাবে সরু অর্থাৎ এর সর্বনিম্ন প্রসস্থ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। তবে যথেষ্ট গভীর হওয়ায় খুব সহজেই বড় বড় জাহাজগুলো নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে।

জাহাজগুলো একটি জটিল লেন ব্যবস্থা অনুসরণ করে; বড় ট্যাঙ্কারগুলো দুটি সরু শিপিং লেন অতিক্রম করে।

ইরান কীভাবে অবরোধ আরোপ করতে পারে?

মধ্যবর্তী ‘বাফার জোনে’ নৌ-মাইন, ছোট নৌকার ঝাঁক অথবা ক্ষেপণাস্ত্র/ড্রোন হামলার মাধ্যমে ইরান চলাচলের হুমকি দিতে পারে।

হুমকি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?

২০০৮ সালের একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছিল যে, ইরান ‘এক মাস পর্যন্ত’ জাহাজ চলাচলে বাধা দিতে পারে, যদি না জোরপূর্বক প্রতিহত করা হয়।

ইতোমধ্যে, কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিস (সিআরএস) ও ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের গবেষণাপত্রগুলো প্রণালিতে ইরানের ‘অপ্রতিসম যুদ্ধ’র উপর আলোকপাত করেছে।

অধিকন্তু, স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেসমেন্ট ও সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড বাজেটারি অ্যাসেসমেন্টের গবেষণায় ইরানের অ্যান্টি-অ্যাক্সেস/এরিয়া ডিনায়েল কৌশলের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মাইন, দ্রুতগামী জাহাজ এবং তীরে ক্ষেপণাস্ত্র।

এরপর কী হবে?

ইরান যদি সিদ্ধান্তটি নিয়েই ফেলে এবং বাস্তবায়নে নির্দেশ জারি করে তাহলে তেল ট্যাঙ্কারদের নতুন রুট খুঁজে বের করাই ভালো। কিন্তু সমস্যা একটা রয়েছে, এবং বড় সমস্যা। কারণ হরমুজ প্রণালির বিকল্প আর একটাও নেই।

স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরণের হুমকির ক্ষেত্রে তেলের দাম তেলের দাম বেড়ে গেছে। চীন, ভারত এবং পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশসহ আমদানিকৃত তেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

গত ২২ জুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও চীনকে ইরানকে প্রণালি বন্ধ করা থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ফক্স নিউজকে বলেন, ‘আমি বেইজিংয়ের চীনা সরকারকে উৎসাহিত করছি যেন তারা এই বিষয়ে তাদের (ইরান) সঙ্গে যোগাযোগ করে, কারণ তারা তাদের তেলের জন্য হরমুজ প্রণালির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল’।

ইতিহাস কী বলছে?

ইরান প্রায়ই হরমুজ বন্ধের কথা বলেছে এবং জাহাজ চলাচলে হয়রানি করেছে অথবা মাইনিং করেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা ঘেটে দেখা যায়, তারা কখনও এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথটি সরাসরি বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। কারণ, টেকসই বন্ধ থাকা তেহরানের জন্য ঠিক ততটাই বেদনাদায়ক হবে যতটা বিশ্বের জন্য।

তেহরান বেশ কয়েকবার যান চলাচল ব্যাহত করার হুমকি দিয়েছে বা চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের জন্য জলপথটি বন্ধ করতে কখনও সফল হয়নি। ১৯৮০-৮৮ সালের ‘ট্যাঙ্কার যুদ্ধ’ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

ইরান প্রণালিতে ও তার কাছাকাছি নৌ-মাইন পুঁতে রেখেছিল, ট্যাঙ্কারগুলোতে সিল্কওয়ার্ম অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, জাহাজগুলোকে হয়রানি করার জন্য ছোট দ্রুত আক্রমণকারী নৌকা ব্যবহার করেছিল।

প্রতিক্রিয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতি ট্যাঙ্কারগুলোকে পুনরায় পতাকাঙ্কিত করে (‘অপারেশন আর্নেস্ট উইল’) এবং কনভয় এসকর্ট পরিচালনা করে; মাইন পরিষ্কার করা হয়েছিল এবং যানবাহন চলাচল অব্যাহত ছিল। 

ইরান জাহাজের ক্ষতি করলেও, তেলের প্রবাহ কখনও থামায়নি।