ঢাকা শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫

বিশ্লেষণ

ইরানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধের পথে হাঁটছে ইসরায়েল?

আল জাজিরা
প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২৫, ০৮:১০ পিএম
গত জুনে ইরানে হামলা চালায় ‘ইসরায়েল’। ছবি- সংগৃহীত

গত জুন মাসে ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধকে ‘সফল অভিযান’ হিসেবে দেখছে ‘ইসরায়েল’। যুদ্ধের সময় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ইরানি সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন, ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা দুর্বল হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ফোরদোর পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় অংশ নিতে রাজি করানো যায়।

তবে ‘ইসরায়েলি’ নেতারা এই বিজয় দাবি করলেও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, প্রয়োজনে আবারও হামলা চালাতে প্রস্তুত তারা। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘গ্যাস প্যাডেল থেকে পা উঠিয়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’

পরবর্তী যুদ্ধের জন্য ‘ইসরায়েল’র অপেক্ষা

বিশ্লেষকদের মতে, ‘ইসরায়েল’ এরই মধ্যে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, যাতে আরও একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানি ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল বা পতনের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি অপরিহার্য, যা তারা দিতে প্রস্তুত কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

গত জুন মাসে ‘ইসরায়েল’র আকস্মিক এক হামলা থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়, যেখানে প্রায় ১ হাজার ইরানি ও ২৯ জন ‘ইসরায়েলি’ নিহত হন।

‘ইসরায়েল’ দাবি করে, তারা ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ হিসেবে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামাতে এই হামলা চালিয়েছে। তবে তেহরান বহুদিন ধরে দাবি করে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে নাগরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

ইরানের সতর্কবার্তা

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান জানান, তারা ‘ইসরায়েল’র যেকোনো আক্রমণের জন্য প্রস্তুত এবং প্রয়োজনে ‘ইসরায়েল’র অভ্যন্তরে আবারও হামলা চালাতে তৈরি ইরানি সশস্ত্র বাহিনী।

যুদ্ধের কারণ ও উদ্দেশ্য

যদিও ‘ইসরায়েল’ জানায়, তারা ইরানের পরমাণু স্থাপনা লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে, বাস্তবে তারা সরকারি ও সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টার্গেট করেছে। এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করা।

যুক্তরাষ্ট্রের কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্লেষক ত্রিতা পার্সি বলেন, ‘নেতানিয়াহু আবারও হামলা চালানোর সুযোগ খুঁজছেন, কারণ তিনি ইরানকে এমন দেশে পরিণত করতে চান, যেমন সিরিয়া বা লেবানন, যাদের ওপর ‘ইসরায়েল’ নির্বিঘ্নে হামলা চালাতে পারে।’

পরবর্তী সুযোগ কী হতে পারে?

বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপীয় দেশগুলো যদি আবার ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে সেটিই হতে পারে ‘ইসরায়েল’র জন্য নতুন হামলার অজুহাত।

এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় একমত হন যে আগস্টের মধ্যে নতুন পারমাণবিক চুক্তি না হলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনরায় কার্যকর হবে।

এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ২০১৫ সালের চুক্তির পর প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়।

পার্সি সতর্ক করে বলেন, ‘ইরান যদি তখন পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (এনপিটি) থেকেও বেরিয়ে যায়, তাহলে ‘ইসরায়েল’র জন্য রাজনৈতিকভাবে আক্রমণের পথ খুলে যাবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি জরুরি

‘ইসরায়েল’র রেইচম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক অধ্যাপক মেয়ের জাভেদানফার বলেন, ‘নতুন হামলা চালাতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমোদন প্রয়োজন হবে, যা বর্তমান বাস্তবতায় অনিশ্চিত।’ যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ‘ইসরায়েলি’ হামলা নিয়ে অসন্তুষ্ট, তাই এমন অনুমতি পাওয়া কঠিন হতে পারে।

গোপন হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েল’ এখনই গোপনে ইরানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতের জন্য চাপ সৃষ্টি করা যায়।

তিন অভ্যন্তরীণ সূত্র এবং এক ইউরোপীয় কূটনীতিক জানিয়েছেন, ইরানের অ্যাপার্টমেন্ট, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দর ও কারখানায় যে আকস্মিক বিস্ফোরণ ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে তা সম্ভবত ‘ইসরায়েল’র নাশকতা কার্যক্রমের ফল।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি (সিআইপি)-এর ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নেগার মোর্তাজাভি বলেন, ‘নেতানিয়াহু এখন এমন একটি কৌশল পেয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি ট্রাম্পের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইরানকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারছেন।’

ইরানের ভেতরে ‘ইসরায়েল’র নেটওয়ার্ক?

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘ইসরায়েল’ ইতোমধ্যে ইরানের ভেতরে একটি বিস্তৃত গোয়েন্দা ও হামলার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যা জুন মাসের সংঘর্ষের সময় প্রমাণিত হয়েছিল।

তেলআবিব থেকে বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘এই ধরনের গোপন নেটওয়ার্ককে মাঝে মাঝে সক্রিয় রাখতে হয়। এটি কৌশলগত তৎপরতা বজায় রাখার জন্য।’

নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা

অনেকেই একসময় নেতানিয়াহুকে সংঘাত পরিহারকারী মনে করলেও এখন তিনি সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এমনকি ইরানের ওপর নির্দয়ভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। গাজায় চলমান সহিংসতার মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন থেকে দৃষ্টি সরাতে ইরানকে টার্গেট করা হতে পারে।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ট্রাম্প কতটা সম্মতি দেবেন।

ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষক অরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘ইসরায়েল’ জানে, ইরান নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে। গাজা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু ইরান নিয়ে নয়। নেতানিয়াহু যদি নিজেকে রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে মনে করেন, তাহলে তিনি আবারও ইরানকে লক্ষ্যবস্তু করবেন।

ইরানের প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক আশা

মোর্তাজাভি বলেন, “ইরান এখন ‘ইসরায়েল’র সম্ভাব্য পরবর্তী হামলার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু একসঙ্গে কূটনৈতিক সমাধানের আশাও ধরে রেখেছে। তারা জানে, একটি কূটনৈতিক চুক্তি ‘ইসরায়েলি’ হামলার সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে।’’ আল জাজিরাকে বলেন তিনি।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান-‘ইসরায়েল’ উত্তেজনা কেবল একটি নতুন যুদ্ধের আশঙ্কাই নয়, বরং পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে।


বিশ্লেষণ:
সাইমন স্পিকম্যান কর্ডাল, তিউনিশিয়ার সাংবাদিক

ম্যাট নাশেদ, সাংবাদিক এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাভিত্তিক বিশ্লেষক