বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই রক্তের ছাপ, সংগ্রামের ধ্বনি, এবং বেদনাবিধুর কাহিনীর ছায়া বিদ্যমান। তেমনি একটি হৃদয়বিদারক অধ্যায় হলো জুলাই মাসের রাজনৈতিক হত্যা, যেখানে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তাদের রক্তে ভিজেছিল এই বাংলার মাটি, আর সেই মাটির গভীরে তারা বপন করে গিয়েছিলেন একটি স্বপ্ন, একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ এবং শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রশ্ন ওঠে, তারা কী এমন স্বদেশ চেয়েছিলেন, যেখানে বিভাজন, স্বার্থপরতা আর নৈতিক অবক্ষয়ের রাজত্ব? আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে সেই প্রশ্ন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
শহিদেরা কী চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে রাজনীতি হবে দুর্নীতির আখড়া, যেখানে গুম, খুন, নিপীড়ন হবে একটি স্বাভাবিক দৃশ্যপট, আর জনগণ থাকবে ভয়, নিপীড়ন আর নীরবতার জালে বন্দি? শহিদদের স্বপ্ন কি ছিল এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে সংবিধান ব্যবহৃত হবে ক্ষমতার অপব্যবহারে, যেখানে বিচার হবে দলীয় আনুগত্যের নিরিখে।
জুলাইয়ে যারা শহিদ হয়েছিলেন, তারা ছিলেন স্বৈরাচার মুক্ত, শোষণ মুক্ত নতুন স্বদেশ গড়ার আদর্শের প্রতীক। তারা বিশ্বাস করতেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ হবে সকলের, হবে ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও অংশগ্রহণমূলক। তারা চেয়েছিলেন একটি বাংলাদেশ, যেখানে একটি শিশুও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে গর্ব করতে পারে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এবং যেখানে জাতীয় নেতৃত্ব হবে গণমানুষের প্রতিনিধি। অথচ আজ, জুলাই শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে, আমরা দেখছি ঠিক উল্টো চিত্র। নাগরিক অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ, সাংবাদিকতা শৃঙ্খলিত, এবং রাজনীতি ক্রমশ পরিণত হয়েছে করপোরেট স্বার্থের দাসত্বে।
রাজনীতিতে এখন আদর্শ নয়, বরং সুবিধাবাদিতা প্রাধান্য পাচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদল মানে আজ কেবল মুখ বদল, নীতি নয়। যে শহিদেরা জাতিকে জাগিয়ে তুলতে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, তারা চেয়েছিলেন এমন নেতৃত্ব, যারা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতায়। অথচ আজকের রাজনীতির মাঠে সেই উচ্চতা নেই; আছে কেবল অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, হীনম্মন্যতা আর আত্মম্ভরিতা।
জুলাইয়ে যারা শহিদ হয়েছিলেন, তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সাংবিধানিক শাসনের, যেখানে আইনের শাসন থাকবে সর্বোচ্চ আসনে। তারা চেয়েছিলেন এমন সমাজ, যেখানে সবাই সমান সুযোগ পাবে, যেখানে মানুষের পরিচয় হবে তার মেধা ও শ্রমে, পার্টি কার্ডে নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীই সব সুযোগ-সুবিধার মালিক। রাষ্ট্রযন্ত্র প্রায় পুরোপুরি দলীয় নিয়ন্ত্রণে, আর বিরোধী মতাদর্শ হলে তা দমন করা হচ্ছে নানা কৌশলে।
আজকে এই দেশে শিক্ষা হয়ে গেছে পণ্যের মতো, স্বাস্থ্যসেবা বিলাসিতা, আর কর্মসংস্থান যেন একটি অলীক স্বপ্ন। তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ খুঁজে বেড়াচ্ছে বিদেশের মাটিতে, যেখানে পাসপোর্টই যেন মুক্তির চাবিকাঠি। অথচ শহিদেরা চেয়েছিলেন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে তরুণদের জন্য থাকবে অনন্ত সম্ভাবনা, থাকবে নিজ ভূমিতে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার। শহিদেরা চেয়েছিলেন একটি বাংলাদেশ যেখানে সত্য বলার জন্য কাউকে প্রাণ দিতে হবে না, মত প্রকাশের জন্য কাউকে কারাভোগ করতে হবে না, এবং গণতন্ত্রের জন্য কাউকে রাস্তায় গুলি খেতে হবে না। তারা যে স্বদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা ছিল একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির, যারা তাদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করবে। আজ সেই আত্মমর্যাদা কোথায়? কোথায় সেই গণতন্ত্র, যেখানে জনগণের ইচ্ছাই হবে শাসনের ভিত্তি? আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে জাতি। শহিদেরা তাদের প্রাণ দিয়েছিলেন জাতির আত্মমর্যাদার জন্য, অথচ আজ সেই আত্মমর্যাদা পদে পদে লাঞ্ছিত। সংবিধান, যেটি হওয়ার কথা ছিল জনগণের অধিকারের রক্ষাকবচ, তা আজ একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যা করা হয়।
আদালতের রায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ, সবই প্রশ্নবিদ্ধ। জনগণ যেন ধীরে ধীরে এই অবিচারকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে, অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে অন্যায়কে সহ্য করতে আগের মতোই। শহিদেরা চাইতেন না এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে জনগণের কণ্ঠরোধ করা হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো অগণতান্ত্রিক আইনে। তারা চেয়েছিলেন এমন এক মুক্ত পরিসর, যেখানে একজন কবিও কথা বলতে পারবেন, একজন তরুণও প্রতিবাদ জানাতে পারবেন, একজন সাংবাদিকও সত্য তুলে ধরতে পারবেন। আজ সেই কণ্ঠস্বরগুলো নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে- ভয়, হুমকি আর নির্যাতনের মুখে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন নতুন করে জাতিকে জাগ্রত করা।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, যখনই অন্যায় মাথাচাড়া দিয়েছে, তখনই এই মাটির সন্তানরা জীবন দিয়ে তা প্রতিহত করেছে। শহিদেরা কেবল অতীতের গল্প নয়, তারা বর্তমানের চেতনার উৎস। তাদের স্বপ্নের স্বদেশ গড়তে হলে, আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই নীতিতে, সেই আদর্শে, যে আদর্শ নিয়ে তারা রক্ত দিয়েছিলেন। সময় এসেছে প্রশ্ন করার- আমরা কী সত্যিই শহিদদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছি, নাকি প্রতিনিয়ত তাদের আত্মত্যাগকে অপমান করছি? আমাদের রাজনীতিবিদরা কী তাদের দায়িত্বে অবিচল, নাকি তারা ক্ষমতার মোহে বিভোর? আমাদের তরুণ প্রজন্ম কী দেশের প্রতি দায়িত্ববান, নাকি তারা শুধু পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে, শহিদের উত্তরাধিকারী হিসেবে। কারণ শহিদ হওয়া মানে শুধু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা নয়, বরং একটি বৃহত্তর সত্য ও ন্যায়ের জন্য নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দেওয়া। আর সেই আত্মত্যাগ তখনই অর্থবহ হয়, যখন জাতি তার দায়িত্ব পালন করে, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করে, এবং শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
জুলাইয়ের শহিদেরা চেয়েছিলেন এমন এক স্বদেশ, যেটি হবে প্রগতিশীল, মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সর্বজনগ্রাহ্য। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আজকের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে, নাগরিক সমাজকে এবং তরুণ প্রজন্মকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দায়িত্ব এড়িয়ে নয়, বরং দায়িত্ব গ্রহণ করেই গড়তে হবে সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ, যা হবে শহিদদের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা। জুলাইয়ের শহিদেরা চেয়েছিলেন একটি বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ তার অধিকার নিয়ে বাঁচবে, সত্য বলবে, স্বপ্ন দেখবে এবং তা বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই স্বপ্ন যেন ধূলিসাৎ হতে বসেছে। তবে আশার আলো এখনো নিভে যায়নি। দেশের ভেতরে-বাইরে যেসব মানুষ সত্যের পক্ষে কথা বলছে, যারা ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছে, তারাই এই জাতির আশা। তরুণদের মধ্যে এখনো যে প্রতিবাদ আছে, সাংবাদিকতার মধ্যে এখনো যে সাহস আছে, নাগরিকদের মধ্যে এখনো যে মনুষ্যত্ব আছে, এসব মিলেই গড়ে উঠতে পারে একটি নতুন ভোরের বাংলাদেশ। সেই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে হবে আমাদের, যে বাংলাদেশ হবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামুক্ত, বৈষম্যহীন, এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী।
শহিদেরা যে স্বপ্ন রেখে গেছেন, তা পূরণ করাই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক দায়িত্ব। না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আজ যদি আমরা না জেগে উঠি, তবে আগামীকাল আর জেগে ওঠার সুযোগ নাও থাকতে পারে। শহিদের রক্ত বৃথা গেলে একটি জাতি কেবল ইতিহাস হারায় না, হারায় তার আত্মা। সুতরাং এখন সময় এসেছে- ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করার, শহিদের স্বপ্নের স্বদেশ গড়ার, এবং সেই বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনার, যেটির জন্য তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের প্রাণ।