ঢাকা রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

‘অনিবার্য ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আরও ভয়ংকর হবে’

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৫, ০৭:২২ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন করে আরও ভয়াবহ সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ড্যানি সিট্রিনোভিচ। তার মতে, তেহরান আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ সংঘাত আগের চেয়ে অনেক বেশি সহিংস ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরান ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ইরান শাখার সাবেক প্রধান সিট্রিনোভিচ বলেন, ইসরায়েল যখন ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল বা উৎখাতের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তখনো তেহরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কোনো চুক্তির চেষ্টা করছে। তার মতে, এই মৌলিক নীতিগত বিভাজনই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিকে ‘প্রায় অনিবার্য’ করে তুলছে।

তিনি বলেন, ‘পরবর্তী যুদ্ধের সূচনা বিন্দু হবে আগের যুদ্ধের সমাপ্তি বিন্দু।’

বর্তমানে আটলান্টিক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য কর্মসূচির অনাবাসিক ফেলো সিট্রিনোভিচ তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের (আইএনএসএস) গবেষক হিসেবেও যুক্ত আছেন। তার মতে, নতুন সংঘাত ‘শুরু থেকেই ভয়াবহ হবে’, এবং এবার এমন কোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থাকবে না, যা যুদ্ধ থামাতে সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, “আগে যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে পারত। কিন্তু এখন ইরান সেই অবস্থায় নেই। তারা মনে করে, প্রতিরোধের ভারসাম্য না আনলে যুদ্ধ থামানোর কোনো অর্থ নেই। এ কারণেই পরবর্তী সংঘাত ‘অনেক বেশি সহিংস ও দীর্ঘস্থায়ী’ হবে এবং এতে আরও বেশি বেসামরিক প্রাণহানি ঘটবে।”

নাতানজের ‘পিক্যাক্স’ পর্বত এলাকায় ও কোলাং গাজ-লা অঞ্চলে নতুন নির্মাণকাজ চালাচ্ছে ইরান। ছবি- সংগৃহীত

এই সতর্কবার্তা এমন একসময়ে এসেছে, যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধকে ‘নির্ণায়ক জয়’ বলে দাবি করছেন। তার বক্তব্য, মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানের হামলায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, ফলে তেহরান যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।

তবে সমালোচকদের মতে, ট্রাম্পের দাবি অতিরঞ্জিত। তারা বলেন, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি হয়তো কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত হয়েছে, কিন্তু শেষ হয়নি। ফলে মূল সমস্যা অমীমাংসিতই থেকে গেছে।

সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ইরান নাতানজের ‘পিক্যাক্স’ পর্বত এলাকায় এবং কোলাং গাজ-লা অঞ্চলে নতুন নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় ইরানের পুরোনো টানেল নেটওয়ার্কের প্রবেশপথ শক্তিশালী করার কাজও চলছে।

ইসরায়েল ও ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধের পর দেশটির অনেক নাগরিকই বিশ্বাস করেছিলেন, ইসরায়েল জিতেছে। তেহরান বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু সিট্রিনোভিচের মতে, এটি বিপজ্জনক ভুল ধারণা।

ইরানের নতুন পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণের স্যাটেলাইট চিত্র। ছবি- সংগৃহীত

তিনি বলেন, ‘আমরা বলি, আমরা জিতেছি। কিন্তু বাস্তবে কিছুই জিতিনি। ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকেও তারা নিজেদের বিজয়ী মনে করছে। উভয় পক্ষই মনে করছে তারা জিতেছে, আর এই মানসিকতাই পরবর্তী সংঘাতকে অবশ্যম্ভাবী করছে।’

সতর্ক করে তিনি আরও বলেন, “ইরানের পুনর্গঠনের সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করা বিপজ্জনক হবে। তেহরান দ্রুত নিহত কমান্ডারদের শূন্যতা পূরণ করেছে, নিয়মিত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার চেষ্টা করছে। ‘ইতিহাস থেকে একটি শিক্ষা স্পষ্ট’। ইরানি শাসনব্যবস্থা অনেকে যেমন দুর্বল ভাবছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।”

ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, ক্ষেপণাস্ত্র সীমা ও আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে আলোচনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে সিট্রিনোভিচ বলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই নতুন সংঘাতের সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও আদর্শিক অবস্থান সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না।

তিনি আরও বলেন, গত যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র উন্নত ইন্টারসেপ্টর মোতায়েন করে এবং বিমান অভিযান পরিচালনা করে ইসরায়েলকে সহায়তা করেছিল। কিন্তু এবার সেই সমর্থন পাওয়া কঠিন হতে পারে। সিট্রিনোভিচের মতে, ‘ট্রাম্প এখন একাধিক সংকটে জর্জড়িত। ফলে ইসরায়েল এবার আরও কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়বে, এবং কম সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে।’

ইসরায়েলি এই সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের লক্ষ্য এখন স্পষ্টভাবে ভিন্ন। ট্রাম্প আশা করছেন, চাপের মুখে ইরান আলোচনার টেবিলে ফিরবে, কিন্তু ইসরায়েলের লক্ষ্য শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। সিট্রিনোভিচ বলেন, ‘যদি ইসরায়েলের উদ্দেশ্য হয় পারমাণবিক ইরানকে ঠেকানো, তবে যুদ্ধ নয় একটি চুক্তিই সেই লক্ষ্য পূরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।’