গাজা যুদ্ধবিরতি স্থিতিশীল করতে ইসরায়েলে পৌঁছেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। ওয়াশিংটন এখন গাজা যুদ্ধবিরতির প্রথম ও নাজুক পর্যায়কে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে আসন্ন আলোচনায় হামাস-ইসরায়েলের কাছ থেকে কঠিন কিছু ছাড় আদায়ের দিকেও জোর দিচ্ছে। তবে খবর এসেছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ পুনরায় শুরুর চেষ্টা করছেন, যা নিয়ে উদ্বেগে আছে ওয়াশিংটন।
ভ্যান্সের এই সফর এমন সময় হচ্ছে, যখন কয়েক দিন আগেই সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর আগে ইসরায়েলি দুই সেনা নিহতের ঘটনার জেরে এই হামলা চালানো হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আশঙ্কা করছে ইসরায়েল হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধবিরতি ভাঙার পথে হাঁটছে।
আল-আরাবিয়ার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আজ মঙ্গলবার ইসরায়েলে পৌঁছেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। এর আট দিন আগে যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হওয়ার পর থেকেই উভয় পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে আসছে। জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়া, ত্রাণ প্রবেশের গতিরোধ এবং সীমান্ত খোলার বিষয়গুলো নিয়ে উত্তেজনা ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আরও কঠিন পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করার ইস্যুতে এখনো উভয় পক্ষই পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি।
এদিকে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স গাজা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে গঠিত মার্কিন-সমর্থিত টাস্কফোর্স পরিদর্শন করবেন। বুধবার (২২ অক্টোবর) জেরুজালেমে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তার। এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ দুই উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার ও স্টিভ উইটকফ ইসরায়েলে পৌঁছেছেন। তারা ইসরায়েলি মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। মিশরের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আল-কাহেরা নিউজ জানিয়েছে, মিশরের গোয়েন্দা প্রধানও মঙ্গলবার ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের এবং স্টিভ উইটকফের সঙ্গে বৈঠক করতে দেশটিতে পৌঁছেছেন।
গাজায় চলমান যুদ্ধ, ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুথিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংঘাত ইসরায়েলকে সামরিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তবে এই শক্তি বৃদ্ধির বিপরীতে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তেলআবিবের সম্পর্ক ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে।
এদিকে, হামাসের নির্বাসিত নেতা খলিল আল-হাইয়ার নেতৃত্বে কায়রোতে চলমান আলোচনা যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ, গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামো এবং বর্তমান যুদ্ধবিরতিকে আরও স্থিতিশীল করার সম্ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছে।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা অনুসারে, গাজায় ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থায় হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এর পরিবর্তে একটি আন্তর্জাতিক বোর্ডের তত্ত্বাবধানে টেকনোক্র্যাটিক ফিলিস্তিনি প্রশাসনিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
আলোচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হামাস গাজা প্রশাসনের জন্য এমন একটি টেকনোক্র্যাটিক কমিটি গঠনের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে, যেখানে তাদের সরাসরি কোনো প্রতিনিধি থাকবে না। তবে এই কমিটি গঠিত হবে হামাস, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সম্মতির ভিত্তিতে।
গত সপ্তাহে হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ নাজ্জাল রয়টার্সকে বলেন, সংগঠনটি এক অনির্ধারিত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে গাজায় নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, গাজায় হামাসের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। ইসরায়েল ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উভয়েই বলেছেন, হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে। তবে নাজ্জাল স্পষ্ট করেছেন, হামাস কোনোভাবেই নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দেবে না।
গত সপ্তাহে গাজার রাস্তায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে হামাস। পরবর্তীতে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে কয়েকজনকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সংগঠনটি। ট্রাম্প এই পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানালেও, মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যপ্রাচ্য কমান্ড হামাসকে ‘অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করার’ আহ্বান জানিয়েছে।
চলতি মাসের শুরু থেকেই ট্রাম্প গাজা যুদ্ধ বন্ধে বৈশ্বিক উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে গাজায় আটক সব জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে; বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে নিহত ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারের অভিযান এখনো চলছে। ইসরায়েল অভিযোগ করছে, হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত করছে।
অন্যদিকে হামাস জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে, তবে ইসরায়েল ভারী উদ্ধারযন্ত্র গাজায় প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। ফলে মরদেহ উদ্ধারের কাজ স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া গাজায় ত্রাণ প্রবেশে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা ও মিশর সীমান্তের রাফা ক্রসিং খোলা না থাকা নিয়েও উত্তেজনা বাড়ছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম অফিস জানিয়েছে, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে মাত্র ৯৮৬টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ ৬ হাজার ৬০০টি ট্রাক প্রবেশের কথা ছিল।
গাজা যুদ্ধবিরতির প্রধান মধ্যস্থতাকারী কাতারের আমির শেখ তামিমও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন। রোববার কাতারের শুরা কাউন্সিলে বার্ষিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের সকল লঙ্ঘন ও দমননীতির নিন্দা জানাই, বিশেষ করে গাজাকে বসবাসের অযোগ্য অঞ্চলে পরিণত করা এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।’
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) আবারও গাজার সব সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রবেশ করতে পারে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, গাজার কিছু অংশে ইতোমধ্যেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মুখপাত্র আবির এতেফা বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখা এখন একান্ত জরুরি। কারণ এটাই একমাত্র পথ, যার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো সম্ভব।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন