উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে ৩১ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবি ও ভিডিও ঘিরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট ছবিগুলোকে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে তুলে ধরা হলেও প্রকৃতপক্ষে এসব ছবি ও ভিডিওর সঙ্গে ঘটনাস্থলের বাস্তব চিত্রের কোনো মিল নেই, এবং এর কিছু এআই-এর মাধ্যমে তৈরি।
এএফপি জানায়, গত ২১ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘বুক শিউরে উঠছে... ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজের মাঠে একটি ট্রেনিং বিমান ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে।’
ছবিগুলোতে দেখা যায়, একটি খেলার মাঠের মাঝে দুটি বিমান পুড়ছে, আশপাশে জরুরি সেবাদানকারী কর্মীরা ও উৎসুক জনতা জড়ো হয়েছে।
একই দিনে আরেকটি ফেসবুক পোস্টে দেখা যায়, একটি যুদ্ধবিমান এক ভবনের পাশে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং চারপাশে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘কিছু আ** ব্যর্থ চালকের গল্প তৈরি করা শুরু করছে... তিনি ব্যর্থ মানে ব্যর্থ! তাকে নিয়ে কিসের গল্প? শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে ১০০+ শিক্ষার্থী মারা গেছে, এটা কি ভাবা যায়??’
এ ছাড়া ২১ জুলাই ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট হওয়ার পর ৩ লক্ষাধিকবার দেখা হয়, যা দুর্ঘটনার মুহূর্তের বলে দাবি করা হয়। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘যেভাবে দুর্ঘটনাটি হয়েছিল।’
ছবিগুলো শুধু বাংলাতেই নয়, বরং থাই, মালয় ও বার্মিজ ভাষাতেও বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টে শেয়ার করা হয়েছে। একই ভিডিও আরও কিছু ফেসবুক পোস্টে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেগুলোর কোনোটিই মাইলস্টোনের দুর্ঘটনার ছবি বা ভিডিও নয়।
এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া ছবি ও ভিডিও
এএফপির সাংবাদিকরা ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি যে ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করেছেন, তার সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোর সঙ্গে একেবারেই মিল নেই।
আসল ছবিতে দেখা যায়, যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ স্কুল ভবনের ভেতরে পড়ে আছে, পাশে একটি পুড়ে যাওয়া ফিউজেলাজ ও ইঞ্জিনও দেখা যায়।
এএফপির একজন ফটোগ্রাফার, যিনি নিজেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, নিশ্চিত করেছেন যে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো দুর্ঘটনাস্থলের নয়।
প্রথম দুটি ভাইরাল ছবিতে দেখা যায়, দুটি পৃথক যাত্রীবাহী বিমান পুড়ে যাচ্ছে। এসব ছবি স্কুল ভবনের কাছাকাছি নয় বরং উন্মুক্ত মাঠে ঘটেছে বলে দেখানো হয়েছে।
এছাড়া, যেসব জরুরি নিরাপত্তাকর্মীকে ছবিতে দেখা যায়, তাদের পোশাক ও সরঞ্জাম বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের সাথে মেলে না।
ছবিগুলো দেখে বোঝা যায় যে সেগুলো এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। যেমন, কিছু মানুষের হাত-পা নেই, শরীরের আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত।
তৃতীয় ভাইরাল ছবিতে দেখা যায়, একটি যুদ্ধবিমান ভবনের পাশে পড়ে আছে, কিন্তু বিমানটি বেশিরভাগই অক্ষত দেখানো হয়েছে। এমনকি পাশে একটি দ্বিতীয় বিমানের অংশও দৃশ্যমান, যা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করার পর দেখা যায়, ছবিটি আগে অন্যান্য পোস্টেও ব্যবহৃত হয়েছে। গুগলের ‘এবাউট দিস ইমেজ’ ফিচার দেখায় এটি গুগলের এআই টুল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
গুগলের ‘ডিপমাইন্ড এআই’ ল্যাব ২০২৩ সালে ‘সিন্থআইডি’ নামে একটি প্রযুক্তি চালু করে, যার মাধ্যমে এআই তৈরি ছবিকে শনাক্ত করা যায়।
একইভাবে, কথিত ভিডিওটিতে নিচে ‘ভিইও’ নামে একটি ওয়াটারমার্ক দেখা গেছে।
‘ভিইও’ হলো গুগলের এআই-ভিত্তিক ভিডিও তৈরি করার একটি টুল, যা ৮ সেকেন্ড দীর্ঘ ভিডিও তৈরি করতে পারে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিও ঠিক ৮ সেকেন্ডের এবং তার মধ্যে ‘মাইলস্টোন’ শব্দটি ভুলভাবে লেখা হয়েছে।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, কীভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীলভাবে তথ্য যাচাই করে তবেই শেয়ার করা উচিত, বিশেষ করে যখন এটি মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত।