ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মহাজাগতিক ‘ওয়াও!’ সংকেতের রহস্য সমাধানের দাবি বিজ্ঞানীদের

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫, ০১:৪০ পিএম
‘ওয়াও!’ সংকেত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করেছে। ছবি- সংগৃহীত

প্রায় পাঁচ দশক ধরে বহির্জাগতিক প্রাণীর (এলিয়েন) প্রমাণ হিসেবে আলোচনায় থাকা এক রহস্যময় রেডিও সংকেত ‘ওয়াও!’ অবশেষে প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার আওতায় আসতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

১৯৭৭ সালের ১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ‘বিগ ইয়ার’ রেডিও টেলিস্কোপে প্রথম শনাক্ত হওয়া এ সংকেতটি ১৪২০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে ৭২ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল, যা মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত উপাদান হাইড্রোজেনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে মিলে যায়। প্রিন্টআউটে অস্বাভাবিক শক্তিশালী ওই বিস্ফোরণ দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরি এহম্যান হাতে লিখেছিলেন বিখ্যাত শব্দটি ‘ওয়াও’।

বছরের পর বছর ধরে সংকেতটির উৎস নিয়ে নানা বিতর্ক ও তত্ত্ব উঠে আসে। কেউ ধূমকেতু কিংবা মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ বলে দাবি করেন, আবার কেউ মনে করেন এটি হতে পারে ভিনগ্রহী সভ্যতার বার্তা। তবে ২০২৫ সালের ১৪ আগস্ট প্রিপ্রিন্ট সার্ভার arXiv-এ প্রকাশিত ‘প্রজেক্ট আরেসিবো ওয়াও!’-এর নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, সংকেতটি আসলে এক জ্যোতির্বিদ্যাগত অগ্নিতরঙ্গের ফল।

পুয়ের্তো রিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবেল মেন্ডেজের নেতৃত্বে গবেষক দলটি ৭৫ হাজার পৃষ্ঠার তথ্য পুনরায় বিশ্লেষণ করেছে। আগের গবেষণাগুলোকেও ডিজিটাইজ এবং পরিমার্জন করেছে। তাদের ফলাফল থেকে বোঝা যায়, সংকেতটি পূর্বের ধারণার চেয়ে শক্তিশালী ছিল অর্থাৎ ২৫০ জনস্কির (রেডিও ও ইনফ্রারেড জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যবহৃত প্রবাহ ঘনত্বের একক) বেশি।

গবেষকরা ধারণা করছেন, সংকেতটির উৎস ছিল একটি ম্যাগনেটার, যা অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্রসম্পন্ন নিউট্রন তারা। ওই তারার অগ্নিতরঙ্গ নিকটবর্তী শীতল হাইড্রোজেন মেঘে আঘাত করে এক ধরনের ‘মেসার অগ্নিতরঙ্গ’ সৃষ্টি করেছিল, যা মহাজাগতিক লেজারের মতো হাইড্রোজেন নির্গমনকে প্রাকৃতিকভাবে প্রবল করে তোলে। তাদের দাবি, এই ব্যাখ্যা সংকেতটির তীব্রতা, সংকীর্ণ ব্যান্ডউইথ এবং এককালীন প্রকৃতিকে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।

গবেষণা প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট, টেলিভিশন সম্প্রচার বা সৌর কার্যকলাপ থেকে আসা স্থলজ হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ বা ধূমকেতুর প্রতিফলনের মতো পূর্ববর্তী ধারণাগুলোও খারিজ করা হয়েছে। আরেসিবো টেলিস্কোপ ধ্বংস হওয়ার আগে ২০২০ সালে হাইড্রোজেন মেঘ থেকে দুর্বল নির্গমন শনাক্ত হয়েছিল, যা এই নতুন তত্ত্বকে আরও সমর্থন করে।

তবে সবাই একমত নন। হাইড্রোজেন তরঙ্গদৈর্ঘ্য বহির্জাগতিক সংকেতের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন বিবেচিত হয়েছে। বিগ ইয়ার প্রকল্পের পরিচালক জন ক্রাউসও একসময় এ সংকেতকে বুদ্ধিমান উৎসের ‘অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ফলে ভিনগ্রহী যোগাযোগের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সম্প্রতি আবিষ্কৃত আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতু ৩আই/এটিএলএএস (সি/২০২৫ এন১) ধনু রাশির কাছ দিয়ে অতিক্রম করছে। এটি নিয়েও সম্ভাব্য সংযোগ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যদিও অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী একে স্বাভাবিক ধূমকেতুর বৈশিষ্ট্য বলেই মানছেন।

‘ওয়াও!’ সংকেত বহির্জাগতিক বুদ্ধিমত্তা অনুসন্ধান কর্মসূচি (এসইটিআই)-তে এখনো সবচেয়ে বিখ্যাত প্রার্থী। যদিও ২০০৩ সালে ‘এসএইচজিবিও২+১৪এ’ নামে একটি স্বল্পস্থায়ী রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এবং ২০২০ সালে সূর্যের নিকতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই থেকে রহস্যময় ন্যারোব্যান্ড সংকেতও শনাক্ত হয়েছিল। পরে সেগুলোর প্রাকৃতিক বা স্থলজ ব্যাখ্যা মিললেও প্রতিটি ঘটনাই ভিনগ্রহী সংকেত আলাদা করার চ্যালেঞ্জকে স্পষ্ট করেছে।

অধ্যাপক মেন্ডেজ বলেন, নতুন বিশ্লেষণ দিয়ে বিষয়টি বন্ধ করা হয়নি, বরং ‘আরও সূক্ষ্ম মানচিত্রের মাধ্যমে ফের চর্চার দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে’। তার দলের লক্ষ্য, ২০২৭ সালের মধ্যে সংকেত আবিষ্কারের ৫০তম বার্ষিকীতে বিগ ইয়ার টেলিস্কোপের সব তথ্য পুরোপুরি ডিজিটাইজ করা। আর ভবিষ্যতের যন্ত্র যেমন স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারে আরও উন্নত সংবেদনশীলতা দিয়ে হয়তো প্রমাণ করতে পারবে, ‘ওয়াও!’ সংকেত আসলেই এক বিরল মহাজাগতিক ঘটনা ছিল, নাকি এলিয়েনের সাড়া।

সূত্র: এক্সপ্রেস ইউকে