ব্যয় সংকোচন নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট ছোট করা হলেও শিল্পের সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেই। বিপরীতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাপে আয় বাড়াতে নেওয়া হয়েছে পদক্ষেপ। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ্যে বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। যদিও প্রস্তাবিত বাজেটে গতানুগতিকের বাইরে তেমন কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কাল্পনিক সংখ্যার সাথে আরেকটা কাল্পনিক সংখ্যাকে তুলনা করা হতে যাচ্ছে। দেশে যত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তার কোনোটিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সবই ছিল কল্পনার জগতে। এবার সেই কল্পনার জগতকেই সামনে রেখে আরেকটা কল্পনার বাজেট তৈরি হতে যাচ্ছে।
আরেক অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, আনু মুহাম্মদ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাজেট হতে যাচ্ছে পুরোনো বোতলে নতুন মদ রাখার মতো অবস্থা হয়েছে। এই বাজেটে নতুনত্ব বা গুণগত কিছু নেই। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার মতোও কিছু দেখা যায়নি। মূলত আগের সরকারের ধারাবাহিকতাই অব্যাহত রেখেছে এই সরকার। এমনকি প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কারের প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন নেই।
অর্থ উপদেষ্টা তার প্রস্তাবিত বাজেটে বলেছেন, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণসহ মধ্যমেয়াদে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, কর অব্যাহতি সুবিধা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা, করজাল সম্প্রসারণ, বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবায় যথাসম্ভব একই হারে ভ্যাট নির্ধারণ করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনাধীন।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আগের বছরের চেয়ে আকারে ছোট ৫৪তম বাজেট উপস্থাপন করে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, এই বাজেট হবে মানুষকেন্দ্রিক, টেকসই উন্নয়নমুখী এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও সুশাসনের ওপর জোর দেওয়া। এজন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সুবিধাভোগীর আর্থিক পরিমাণও সামান্য বাড়িয়েছে। যদিও প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সুবিধাভোগীদের জন্য এটি কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলেই অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও নাগরিক সেবার মানোন্নয়নে। প্রথাগত ভৌত অবকাঠামোর চেয়ে মানব উন্নয়নকে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা এই বাজেট সাজিয়েছি শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নির্গমনভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য সামনে রেখে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের অংশ হিসেবে সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যার সব প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধন এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘের ইউএনসিএসি কনভেনশনের আওতায় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে তুলে ধরা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, ভূমি প্রশাসন ও নিরাপত্তা খাতেও বিভিন্ন আইনি এবং প্রযুক্তিগত সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যেমন, পুলিশের প্রতিবেদন ছাড়াই পাসপোর্ট প্রদান, ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশন এবং বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে অধ্যাদেশ প্রণয়নের বিষয়টিও বাজেট বক্তৃতায় উঠে এসেছে।
অর্থ উপদেষ্টার ভাষ্য অনুযায়ী, আগের সরকারের দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণ ২০.২০ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে।
পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ, কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং নতুন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে উৎসাহ প্রদানসহ পুঁজিবাজার সংস্কারে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বাজেটের সারমর্ম তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, জনগণের সহযোগিতায় আমরা একটি বৈষম্যহীন, টেকসই এবং জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই, যেখানে অর্থনীতি শুধু প্রবৃদ্ধির অঙ্কে নয়, মানুষের জীবনে গুণগত পরিবর্তন আনবে।
অর্থ উপদেষ্টা তার প্রস্তাবিত বাজেটে বলেছেন, দারিদ্র্য, প্রান্তিক ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য হ্রাস, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবারের বাজেটে সুবিধাভোগীর সংখ্যা এবং মাথাপিছু বরাদ্দ উভয়ই বৃদ্ধি করার দিকে নজর দিয়েছি। এ প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছর থেকে বেশকিছু ভাতার হার বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করছি।
এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো বয়স্ক ভাতার মাসিক হার ৬০০ টাকা হতে ৬৫০ টাকায়, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের মাসিক ভাতা ৫৫০ টাকা হতে ৬৫০ টাকায়, প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা ৮৫০ টাকা হতে ৯০০ টাকায় এবং মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রদত্ত মাসিক ভাতার হার ৮০০ হতে ৮৫০ টাকায় বৃদ্ধি। এছাড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য মাসিক ভাতার হার ৬৫০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন।
মূল্যস্ফীতির কশাঘাত থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে জানুয়ারি ২০২৫ থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের মাধ্যমে স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডের ভিত্তিতে ৫৭ লাখ পরিবারকে মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ আগামী অর্থবছরে ৬ মাসে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে বর্তমানে সহায়তাপ্রাপ্ত ৫০ লাখ পরিবারের অতিরিক্ত আরও ৫ লাখ পরিবারকে এর আওতাভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পেনশন ব্যতীত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সহজে সেবা প্রদানের জন্য ননস্টপ সাভিস পোর্টাল থেকে বর্তমানে ৪৩টি সংস্থার ১৩৪টি সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে একটি সিঙ্গেল প্ল্যাটফর্মে আবেদন, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায় বাংলাদেশ সিঙ্গেল খোলা হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগকারীদের একটি পাইপলাইন তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিকে ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃত বিনিয়োগে রূপান্তর করা হবে। এছাড়া দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন উৎসাহিত করার দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে।
এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন উৎসাহিত করার জন্য এই তহবিলে আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সচল রাখতে জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে তা সাশ্রয়ী রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে নীতিগতভাবে বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এদিকে বাজেট ছোট করার জন্য সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া বেশকিছু প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস/বৃদ্ধি অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর প্রভাব নিরূপণে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলায় বিবেচ্য প্রকল্প কতটুকু সহনশীল তা প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণের সময় যাচাই ও মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এদিকে ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বাভাবিক নিয়মে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিক উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বাণিজ্যিক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লজিস্টিকস্ খাতের উন্নয়নসহ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং বাণিজ্য সম্ভাবনাময় বিভিন্ন দেশ ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের সাথে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরসহ বিভিন্ন পক্ষেপ বাস্তবায়নের কাজ চলমান। যা বিগত সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হলেও বর্তমান সরকারের নতুন কোনো উদ্যোগ প্রস্তাবিত বাজেটে লক্ষ্য করা যায়নি।
প্রান্তিক পর্যায়ের সিএমএসএমই খাতের ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ, ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে ৩ হাজার নারী উদ্যোক্তাদের সাথে কর্পোরেট ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অপরদিকে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয় মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমির মাধ্যমে মহিলাদের জন্য দক্ষতাভিত্তিক কর্মসূচির জন্য ১২৫ কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা, ২০০৮ যুগোপযোগী করে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়নের কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতকরা ৩০ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে ২০২৫-২৬ হতে ২০২৭-২৮ পর্যন্ত সময়ে বাপেক্স কর্তৃক প্রয়োজনীয় জরিপ কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, মধ্যমেয়াদে বাপেক্সের নিজস্ব রিগ দ্বারা ৬৯টি কূপ খনন এবং ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিশোধিত তেলের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল শোধন ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, ইউনিট-২ স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
সরকার টেকসই, নিরাপদ, ব্যয়সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সড়ক নেটওয়ার্ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিদ্যমান ‘রোড মাস্টার প্ল্যান ২০০৯’ হালনাগাদকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
নিরাপদ, আরামদায়ক এবং সাশ্রয়ী হিসেবে রেল পরিবহন বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে বাংলাদেশে এ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে ৩০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ রেলওয়ে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ, গেজ একীভূতকরণ, আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেমের প্রবর্তন, সমুদ্র বন্দরের সাথে রেল যোগাযোগের উন্নয়ন, আপগ্রেডেড লোকোমোটিভ প্রবর্তন এবং বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশন প্রবর্তন ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয়েছে এবং যমুনা রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ শেষে রেল চলাচল শুরু হয়েছে। এসব পদক্ষেপই বিগত সরকারের রেখে যাওয়া চলমান প্রকল্পের অংশ।
ক্যাশলেস সোসাইটি বিনির্মাণ, আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বৃদ্ধিতে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মোবাইল আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে যাচ্ছে যা তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানো, সরকারি বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা গ্রহণ ও সেবার বিল পরিশোধ, রেমিট্যান্স গ্রহণসহ নানাবিধ আর্থিক সেবা সহজে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যা এই সরকার আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় রেখেছে।
সারাদেশে ৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটিডি ডিজিটাল ল্যাব ও ৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটিডি স্কুল অফ ফিউচার স্থাপন করা হয়েছে। সারা দেশে ৪৯১টি উপজেলায় উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে তরুণ-তরুণীরে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ‘উপজেলা সেবা ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ নির্মাণ করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা বিবেচনায় এবং এ খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা স্টার্ট-আপ তহবিল হিসেবে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশের বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৯২টি প্রকল্পের অনুকূলে প্রায় ১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার বিশেষ গবেষণা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। উন্নয়নের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছার জন্য বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী অর্থবছরে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা এবং সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ ও এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে যে দেশগুলো রয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ প্রতিরোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রশমন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রভাব নিরূপণ, নারীর অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় ইকোসিস্টেম মূল্যায়ন, জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনে গণমাধ্যমের সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির গভীরতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিগগিরই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এছাড়া, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন রাখা হয়েছে। এই বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। গত দেড় দশকে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাই আমরা নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছি এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও আদেশ সংশোধন ও সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
এদিকে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত টাকা বৈধ করার বিষয়ে বর্তমান সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েও বর্তমান তা অব্যাহত রাখতে যাচ্ছে। এজন্য অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
পাশাপাশি ভবনের নির্মাণের এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বাজেট কাঠামো
প্রস্তাবিত ব্যয়: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৫ সালের পর অদ্যাবধি কোনো বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ৯.০ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন: আগামী অর্থবছরে আমাদের সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ও ঋণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৩.৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, এর মধ্যে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে সংগ্রহ করা হবে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে নির্বাহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে নন-এডিপিসহ এই ব্যয় হবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ৫.৫ শতাংশ, যা টাকার অংকে হবে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। আর মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ।
আনু মুহাম্মদ বাজেট বিষয়ে বলেন, আগে যে বাজেট হয়েছে, সেখান থেকে এবার সংখ্যাটা ছোট হয়েছে। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন আগের জায়গায় রয়ে গেছে। অনেকটা আগের সরকারের ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারেনি। আসলে রাজস্ব আয়কে ভিত্তি করে বাজেট করা উচিত। তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে টাকার সরবরাহ থাকত। বিনিয়োগ থাকত। সুদের হার কমে আসত। বিদেশি ঋণ কমে আসত। কিন্তু সেই জায়গা থেকে আমরা সরে আসতে পারিনি। সুতরাং আমি মনে করি, মৌলিক জায়গার ভুলটা রয়ে গেছে।
একই বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে আগের কোনো সরকারই টার্গেট বাস্তবায়ন করতে পারেনি। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৪.৫-এর বেশি হবে না। আবার আগামী অর্থবছরের বাজেটে যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ ধরা হয় তাহলে প্রবৃদ্ধি ১০০ বেসিস পন্টে বাড়বে। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে ২০০ বেসিস পয়েন্ট কমাতে হবে। যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য না।
তিনি বলেন, এদিকে ঘাটতি গত বছরের তুলনায় জিডিপি অনুপাতে কমলেও টাকার অংকে চিত্রটা অন্যরকম হবে। ফলে বিদেশি উৎস থেকে যা পাওয়া যাবে তাও খুব একটা সুখকর না। ফলে ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অন্য সরকারের বাজেটের মতোই নেতিবাচক ধারায় থাকবে। ফলে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুব একটা থাকবে না।
এই অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কম হলে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, কমবে না। তাই কল্পনার জগত থেকে বের হয়ে বাস্তবায়নযোগ্য বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রস্তাব করতে হবে। যাতে নতুন বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া যায়।
আপনার মতামত লিখুন :