শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকেই গোপালগঞ্জ জেলাজুড়ে ফ্যাসিস্টদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী পলাতক। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বিদেশে পালিয়ে যান। তবে সারা দেশের যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাদের একাংশ নিজেদের রক্ষা করতে গোপালগঞ্জে আত্মগোপনে রয়েছেন। বিশেষ করে এনসিপির কর্মসূচির আগেই অনেক জেলা থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীরা সেখানে জড়ো হন। তাদের উপস্থিতিতে গোপালগঞ্জ দুর্গে পরিণত হয় বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন। সেখান থেকেই দেশে নৈরাজ্য চালাচ্ছে পতিত সরকারের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। সবশেষ গত বুধবার এনসিপির কর্মসূচিতেও নেতাদের ওপর দফায় দফায় হামলার নির্দেশনা দিয়েছেন বিদেশে পলাতক ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ আরও কয়েকজন নেতা। মূল পরিকল্পনা ছিল ভারতে পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এ-সংক্রান্ত একাধিক অডিও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।
সূত্রমতে, সম্প্রতি গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘১৬ জুলাই: মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি প- করতে বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের টার্গেট ছিল, এনসিপিকে ঢুকতে দেওয়া হলেও তাদের জীবিত বের হতে দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা। এই মিশন সফল করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় ছাত্রলীগকে। স্বয়ং গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে মোবাইল ফোনে গোপালগঞ্জে ও সেখানে আত্মগোপনে থাকা একাধিক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। এনসিপির বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিতে বেশ কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ দেন হাসিনা। এর সঙ্গে ভারতে পলাতক নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশ দেন।
সূত্রমতে, গোপন এক অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালকে বলেছেন, ‘এনসিপি গোপালগঞ্জ আসলেই এলাকাবাসী তোমরা দেখে নিবা। টুঙ্গিপাড়ায় আমাদের বাবার কবর ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে ওরা, ওদের জায়গা গোপালগঞ্জ তো দূরের কথা, এ দেশের মাটিতে হবে না। ওরা যদি গোপালগঞ্জের মাটিতে কখনো পা রাখে, তাহলে ওদের কেউ যাতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে, সেই নির্দেশনা নিয়ে কাজ করবে তোমরা ছাত্রলীগসহ অন্যরা।’
আরেকটি অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও শহরের বেদ গ্রামের বাসিন্দা নিউটন মোল্লাকে বলেন, ‘তোমরা ওখানে (গোপালগঞ্জে) বসে কী কর? ওরা (এনসিপি) বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করছে।’
পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে লোকজন একত্রিত করে গোপালগঞ্জে ঢুকবে। এরপর টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। যেভাবে পারো, ওদের প্রতিহত করতে হবে। টুঙ্গিপাড়ায় যাতে কোনোভাবেই ওরা ঢুকতে না পারে। আর যদি টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকেই পড়ে, তাহলে একজনও যাতে জীবিত অবস্থায় ওখান থেকে ফিরে যেতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরদিন বুধবার গোপালগঞ্জ পৌর পার্ক মাঠে এনসিপির কর্মসূচির দিন সকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই স্থানীয় চরদুর্গাপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার বিষয়টি এলাকায় জানান দেন আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শহরের মোহাম্মদপাড়ার বাসিন্দা এই আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই পরে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে কয়েক দফা গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়।
জানা যায়, কেবল নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগই নয়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেন। গোপালগঞ্জের মাটিতে এনসিপি যাতে কোনোভাবেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সে জন্য প্রত্যেককে তিনি নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার নির্দেশের পর এনসিপির কর্মসূচি প- করাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে গোপালগঞ্জে থাকা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চতুর্দিক থেকে একযোগে হামলা চালান।
এ সময় নেতাকর্মীদের সমন্বয় করেন কলকাতায় থাকা শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, লন্ডনে বসে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু এবং গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজল। তাদের বাইরে গোপালগঞ্জসহ আশপাশের জেলা-উপজেলায় আত্মগোপনে থাকা নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। কলকাতায় আত্মগোপনে থেকেই ফেসবুকে লাইভে এসে তিনি মাঠের কর্মীদের এনসিপির কর্মসূচিতে হামলা করতে নির্দেশনা দেন।
স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের এ কাজে সংগঠিত করেন কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজলের স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ইয়াসমিন আলম। যদিও বিষয়টি জানার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে আটক করে। ১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি। ইতিমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় কর্মসূচি পালন করে দলটি। মাসব্যাপী এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার ছিল গোপালগঞ্জে পদযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্রমতে, ৫ আগস্টের পর গোপালগঞ্জের জেলা ও বিভিন্ন উপজেলায় অপরিচিত মানুষের পাল্লা ভারী হতে থাকে। সেখানে নতুন করে বাড়তে থাকে হাজার হাজার মানুষের বসবাস। সম্প্রতি ডিবি পুলিশের একটি প্রতিবেদনেও এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর কাছ থেকেও গোয়েন্দারা এসব তথ্য সংগ্রহণ করেছে। আগেভাগেই এসব তথ্য থাকার পরও গোপালগঞ্জ রণক্ষেত্র হলো, সেটা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে পড়েছে সরকার ও এনসিপি।
পুলিশের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এই শহরে ৫ তারিখের পর একশ্রেণির অপরিচিত মানুষের চলাফেরা বাড়লেও সেটি মাথায় রেখে এনসিপির সমাবেশে নিরাপত্তার জন্য সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর ছিল। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টায় নিষিদ্ধ সংগঠনের একটি সন্ত্রাসী দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পুলিশের এক পরিদর্শকসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়। পরে ঘটনাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এ বিষয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গোপালগঞ্জে আমাদের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আক্রমণ চালানো হয়। ফ্যাসিস্টরা ও তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে আগে থেকেই আত্মগোপনে ছিল। তারা এটাকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছে। আমরা গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষকে মুজিববাদ থেকে মুক্ত করব। গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের পাশে আমরা আছি। আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাতে চাই, গোপালগঞ্জের একজন সাধারণ মানুষকেও যেন হেনস্তা করা না হয়। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করতে হবে। যেসব ফ্যাসিস্ট আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উৎখাত করলেই গোপালগঞ্জ মুক্তি পাবে।
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, সরকার ও এনসিপির যৌথ পরিকল্পনায় এই গোপলগঞ্জ সফর হয়েছে কি না, এর পেছনে তিনি যুক্তি দাঁড় করিয়েছেনÑ ৫ আগস্টের পর সেখানে সেনাবাহিনীর গাড়িতে হামলা, বিএনপি নেতাকে হত্যা, পুলিশের থানা ঘেরাও, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে, যা থেকে বোঝা যায়, আসলে সরকারের অলমোস্ট কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই ওই জেলার ওপর। এর পরও কেন যেতে দেওয়া হলো এনসিপিকে? সরকার এই পরিস্থিতিতে চাইলেই এনসিপিকে গোপালগঞ্জ সফরে যেতে বারণ করতে পারত। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এরকম একটা প্রস্তুতি নিচ্ছে, তারা এসে সঙ্ঘবদ্ধভাবে এই কাজ করবে। এটা এক-দুই দিনের প্রস্তুতি না, এটা দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি এবং এ তথ্য পাওয়া গোয়েন্দা সংস্থার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না।
এসব নিয়ে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেছেন, বর্তমানে পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। যারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রশাসন কাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, দেশের মানুষ বুঝতে পারছে। ঘটনার শুরুতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও পরে ব্যাপকভাবে বিশৃঙ্খলা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :