মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

নেই ফার্মাসিস্ট, ওষুধ দেন নার্স-ওয়ার্ডবয়

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছেন ফার্মাসিস্টরা। দেশ এখন বছরে ৯৮ শতাংশ দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। অথচ দেশের রোগীরা সেই দক্ষতার সুফল পাচ্ছেন না। কারণ চিকিৎসাব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের যুক্ত করা হয়নি। সারা দেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে শয্যাসংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। কিন্তু এসব হাসপাতালে একজনও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি ২৫ শয্যার জন্য একজন করে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক।

বাস্তবে সেই নির্দেশনা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। ফলে দেশের ওষুধ ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে মারাত্মক সংকট, যা রোগীর সুরক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নির্ধারিত ফার্মাসিস্ট না থাকায় হাসপাতালগুলোতে ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন নার্স বা ওয়ার্ডবয়রা। এতে করে ওষুধের ভুল প্রয়োগে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দক্ষতার অভাবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ওয়ার্ডবয়রা নিজেদের ফায়দার জন্য মজুত করছে জরুরি বিভিন্ন ওষুধ। দিনের পর দিন এগুলো মজুত রাখার কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বরাদ্দকৃত ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট পদ তৈরি এখন সময়ের দাবি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের অভাব, শয্যাসংকট বা ওষুধ ঘাটতির মতো সমস্যা প্রায়ই আলোচনায় আসে। কিন্তু আরেকটি নীরব সংকট দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত, এটি হলো ফার্মাসিস্টের অনুপস্থিতি। প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতালেই রোগীদের ওষুধ দেওয়া হয় কোনো প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট ছাড়াই। অথচ আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় ফার্মাসিস্ট ছাড়া একটি হাসপাতাল কল্পনাও করা যায় না।

তারা বলছেন, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওষুধ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা ফার্মাসিস্টদের। অথচ অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেই ফার্মাসিস্টদের জন্য নির্ধারিত পদ বা কর্মক্ষেত্র গড়ে ওঠেনি। এই অভাব চিকিৎসাসেবার গুণগত মান ও রোগীর নিরাপত্তাÑ উভয়কেই প্রভাবিত করে। ওষুধের সঠিক ব্যবস্থাপনা, প্রেসক্রিপশন যাচাই ও ভুল ওষুধ প্রয়োগ প্রতিরোধ, রোগীকে ওষুধ ব্যবহারের সঠিক নির্দেশনা দেওয়া, ড্রাগ ইন্টার‌্যাকশন ও সাইড ইফেক্ট সম্পর্কে সচেতনতাসহ হাসপাতালে ওষুধের গুণগত মান ও মজুত পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু  বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজধানীসহ দেশের কোনো জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেই  কোনো ফার্মাসিস্ট পদ নেই। অনেক বড় হাসপাতালেও ওষুধ বিতরণে অনভিজ্ঞ কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করে। কিছু জায়গায় চুক্তিভিত্তিক বা অস্থায়ীভাবে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনবল কাঠামোয় ফার্মাসিস্ট পদের সংখ্যা খুবই সীমিত এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ওষুধ ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট পদ রাখার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নীতিমালাতেই ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। রয়েছে জনবল কাঠামোর জটিলতাও।

হাসপাতাল প্রশাসন ও পিএসসির মধ্যে সমন্বয়হীনতা, চিকিৎসক-প্রধান মনোভাব, চিকিৎসাব্যবস্থায় অন্যান্য পেশাজীবীকে (ফার্মাসিস্ট, নার্স) গুরুত্ব কম বিবেচনা, অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি, নতুন পদ সৃষ্টিতে বাজেট সীমাবদ্ধতা, নীতিনির্ধারকদের অজ্ঞতা। শুধু তা-ই নয়, অনেকে এখনো ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কেই সচেতন নন। এর ফলে ভুল ওষুধ প্রয়োগে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন যাচাই না করা এবং অনুপযুক্ত ওষুধ মজুত এবং নষ্ট হওয়ায় রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হচ্ছে।

শুধু ফার্মাসিস্ট পদ না থাকায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভুল ওষুধ প্রয়োগের কারণে মারা যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন পাবনা সদর দোগাছি ইউনিয়নের হাসমত আলী (৪০)। বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে কর্তব্যরত পল্লী চিকিৎসক একযোগে চারটি ইনজেকশন পুশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। একইভাবে ভুল ওষুধ প্রয়োগে মৃত্যু হয় নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৫ বছর বয়সি ফুলেছা খাতুনের। একই রকম ঘটনা ঘটে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। সেখানকার সিনিয়র স্টাফ নার্স ভুল ইনজেকশন প্রয়োগ করেন, ফলে দুই রোগী (মালিক ও জহিরুল ইসলাম) মারা যান। ওষুধের ভুল প্রয়োগে খোদ রাজধানীতেও মারা যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে যথেচ্ছভাবে ওভারডোজে ওষুধ প্রয়োগে মৃত্যু হয় ১৭ বছর বয়সি এক শিক্ষার্থীর। ২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এই ভুলের প্রমাণ পেয়ে সংশ্লিষ্ট দুই চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশনও স্থগিত করে। 

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত জনবল কাঠামোয় ফার্মাসিস্ট পদ অন্তর্ভুক্ত করা। এ ছাড়া হাসপাতাল পর্যায়ে ওষুধ ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা বিভাগ তৈরি, ফার্মেসি কাউন্সিলের মাধ্যমে তদারকি জোরদার করা, চিকিৎসকদের পাশাপাশি ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্তি ও মতামত গ্রহণ করা।

তিনি বলেন, ফার্মাসিস্টদের অবহেলা শুধু একটি পেশার প্রতি নয়, বরং গোটা চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি অবিচার। রোগীর নিরাপদ চিকিৎসার স্বার্থে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্টদের নিয়মিত ও স্থায়ী পদ সৃষ্টি এখন সময়ের দাবি।

তবে স্বাস্থ্যনীতিতেই দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও নার্সদের গুরুত্ব দেওয়া হলেও ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব তেমনভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পিএসসির মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বহু বছর ধরে নতুন পদ সৃষ্টি আটকে আছে। স্বাস্থ্য খাতের অধিকাংশ প্রশাসনিক পদে চিকিৎসকেরা থাকেন। অনেক সময় তারা অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজীবীর (যেমন : ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট) ভূমিকা ছোট করে দেখেন।

ফার্মাসিস্টদের জন্য আলাদা পদ সৃষ্টি ও নিয়োগে বাজেট বরাদ্দ না থাকায় অনেক হাসপাতাল উদ্যোগ নিতে পারে না দাবি করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এর প্রভাবে ভুল ওষুধ প্রয়োগে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হুমকি।

এ ছাড়া মূল্যবান ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হচ্ছে, রোগীরা সঠিক ওষুধ ব্যবহারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং রোগ প্রতিকারে বিলম্ব ঘটছে। সরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট না থাকা শুধু চিকিৎসা নয়, রোগীর জীবন নিয়ে খেলা। তাই ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বা মজুত তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত লোক থাকা উচিত।

তিনি বলেন, অনেক সময় ওষুধ নিয়ে রোগীদের নানা প্রশ্ন থাকে, যেগুলোর উত্তর দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত কেউ থাকেন না। এতে চিকিৎসকের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নার্সদের মধ্যে ৩৮ শতাংশের মারাত্মক ওষুধ নির্ণয়ে ত্রুটি আছে, তার কারণ কম কর্মীসংখ্যা, প্রশিক্ষণের ঘাটতি ও চিকিৎসক-নার্সের যোগাযোগের অভাব।

শুধু তা-ই নয়, দেশের হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্টের পদ না থাকায় প্রেসক্রিপশনে গড় ওষুধের সংখ্যা ও অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার রোগীর ওপর ঝুঁকি বাড়ায়। প্রেসক্রিপশন পুরোপুরি অনুসরণ না করায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হয় এবং ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়। প্রেসক্রিপশনে ভুলের উচ্চহার রোগ নির্ণয়ে ভুল ও ভুল চিকিৎসা সৃষ্টি করে। ফার্মাসিস্ট না থাকায় নার্স বা অনভিজ্ঞ কর্মীদের ভুলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। ফার্মাসিস্টের অনুপস্থিতি শুধু চিকিৎসা নয়, অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সভাপতি মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় হাসপাতাল ফার্মাসিস্ট ছাড়া গুণগত স্বাস্থ্যসেবা অসম্ভব। অথচ দেশে এখনো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়াই ওষুধ সংরক্ষণ, ডিসপেন্সিং ও বিতরণ চলছে। ডাক্তার, নার্স এবং ফার্মাসিস্ট একত্রে কাজ করলে রোগী পাবেন নিরাপদ চিকিৎসা।

তিনি বলেন, জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬-এর ৪.৩ অনুচ্ছেদে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধানে হসপিটাল ফার্মেসি কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। ফলে ওষুধের অপব্যবহার এবং অনিরাপদ ব্যবহারে রোগীরা বিপদে পড়ছেন।

কেন দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টরা যুক্ত হতে পারছেন না এমন প্রশ্নে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হতে হলে সবার আগে ফার্মাসিস্টদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সরকার নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৭০০ নতুন ফার্মেসি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কাজ করবেন। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। হাসপাতালে ফার্মাসিস্টের অংশগ্রহণ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!