আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক দল ও মতের ঐক্যবদ্ধ হাত ছিল ইস্পাত কঠিন। সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো চাপ, নির্যাতন এবং নিপীড়ন সেই ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। ফলে মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনের পতন হয়েছিল সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা আকড়ে থাকা শেখ হাসিনা সরকারের। কিন্তু অভ্যুত্থানের এক বছর যেতে না যেতেই ইস্পাত কঠিন সেই ঐক্যে দেখা দিয়েছে ফাটল। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো এখন বিপরীতমুখী। রাজনৈতিক মতাদর্শ, ভিন্নমতসহ নানা ইস্যুতে বিরোধ দেখা দেওয়ায় দলগুলোর নেতাকর্মীরা একে অপরকে নিয়ে বলছেন শিষ্টাচারবহির্ভূত ও বিষোদগারমূলক কথা।
রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটলের কারণে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে নেমেছিলেন সাধারণ ছাত্র-জনতা তা সুদূরপরাহত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সব দল যদি ঐক্যবদ্ধ থাকত তাহলে সংস্কার, বিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া যেত। মানুষের আকাঙ্ক্ষা কিছুটা হলেও পূরণ হতো। কিন্তু বিভক্তির পর সবাই যার যার স্বার্থ হাসিলে মরিয়া হয়ে পড়ায় মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলছে না।
গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিদিনই পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করছেন, বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ ছাড়া ছাত্রসংগঠনের দ্বন্দ্ব সংঘাতেও রূপ পাচ্ছে। তবে সরকার পতনের আন্দোলনে নজিরবিহীন ঐক্যের পর মাত্র এক বছরের মধ্যে কীভাবে তাতে ফাটল ধরল, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। কেউ বলছেন- ক্ষমতার দ্বন্দ্ব; কারো মতে, বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন দল মতামত দেবে, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কেউ কেউ আবার এতে বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দায়ও দেখছেন।
রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন থাকলেও একমঞ্চ থেকেই আন্দোলন করে গেছে সব রাজনৈতিক দল। গত আগস্ট মাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও আজও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর দূরত্ব বাড়ছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ, উঠেছে বৈষম্যের অভিযোগ।
ঐক্যের পরিবর্তে দ্বন্দ্বের রাজনীতি
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন এবং তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে নতুন সূর্যোদয়ের আশায় বুক বেঁধেছিল অনেকেই। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তি, গণতন্ত্র ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার প্রশাসন নানা জটিলতার মধ্যে পড়েছে। সহিংসতার বিক্ষিপ্ত ঘটনার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে গভীর মতবিরোধ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই দুই পুরোনো রাজনৈতিক শক্তিকে উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের একাংশ জাতীয় নাগরিক দল বা এনসিপি গঠন করেছে। তারা নতুন ধারা ও সংস্কারের কথা বললেও তাদের বিরোধীরা অভিযোগ করছে এনসিপি আসলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্রয়ে বিকশিত এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে।
এদিকে হাসিনা সরকারের শাসনামলের দমননীতি কাটিয়ে এক দশকের বেশি সময় পর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের জন্য অতীতের ভার বহন করা এ দল আবার সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরেছে এবং এতে ভোটের মাঠে বিভাজন আরও তীব্র হয়েছে।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হওয়ায় তার দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা রাজনীতিতে এক বড় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। সেই ফাঁকা জায়গা পূরণে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সক্রিয় হলেও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে একমত হলেও কোন সংস্কার আগে এবং কতটুকু পরিবর্তন জরুরি তা নিয়ে মতপার্থক্য তীব্র। প্রধানমন্ত্রিত্বে মেয়াদ নির্ধারণ, সংসদ কাঠামোয় পরিবর্তন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চললেও চূড়ান্ত ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। যে কারণে জাতীয় ঐক্যের ফাটল দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘ সময় চায় সংস্কার সম্পন্ন করতে, অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে চায়। এনসিপির অবস্থান জামায়াতের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হওয়ায় এ বিভাজন আরও প্রকট হয়ে ওঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল। জানান, ‘শুরু থেকে সামনে থেকেই আমরা আন্দোলন করেছি। গুলি লেগেছে আমার গায়ে, আমাদের ভাই-বোনেরা শহিদ হয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ থাকে না, কিছু সিলেকটিভ মানুষ দেখা করতে পারে তখনই খারাপ লাগে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নাল আহমেদ বলেন, ‘শুধু নিজেদের দলের লোককে (এনসিপি) ফ্রন্টলাইনে রেখে সুযোগ-সুবিধা দেবেন আর বাকি স্টেকহোল্ডারের প্রতি কোনো ধরনের তোয়াক্কা করবেন না, এ বেইনসাফের সমালোচনা আমরা করবই। ক্রাইসিস মোমেন্টে একদিকে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন ঘরানার ছাত্রদের একত্রিত করবেন আর অন্যদিকে ক্ষমতার বলয়ে শুধু নিজেদের লোকজনকে বসিয়ে ইনসাফের মিথ্যা আশ্বাস দেবেন, সেটা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।’
বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘দেশের মানুষ ও আমরা দলমত নির্বিশেষে এক ব্যানারেই আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি তার উল্টোটা। ছাত্র সংগঠনগুলোর জাতীয় ঐক্য ভাঙার জন্য কয়েকটি চক্র কাজ করছে এবং এটির ফাটলের পেছনে তারাই দায়ী।’
ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি নূরুল বশর আজিজী বলেছেন, ‘এর আগে আমরা দেখেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রোগ্রামে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ডাকেনি। বিপ্লবের অংশীদারদের মাইনাস করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। বিষয়টা আমাদের ও দেশের মানুষের ভালো লাগেনি। কাজেই এসব রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ঐক্যের ফাটল ধরছে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামীন মোল্লা বলেন, ‘কাউকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, দূরে রাখা এটি জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এটা দূর করতে হবে, তা না হলে ঐক্যের ক্ষেত্রে বড় বাধা আসবে আর এ সুযোগে ফ্যাসিবাদীরা জেগে উঠতে শুরু করবে। কাজেই ঐক্যের ক্ষেত্রে সবাইকে সহনশীল হওয়া ভালো।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবির) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, গণতান্ত্রিক ধারা হলো বহুদলীয় গণতন্ত্রে বহুমত। কিন্তু সেগুলো নিরসনও করতে হবে জনগণের দ্বারা। রাজনৈতিক সংকট ও দেশব্যাপী নানা ধরনের সমস্যা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাধান করা জাতীয় ঐক্য। সেই ঐক্য ৫ তারিখের পর থেকে বিভাজন হতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের পর আমরা লক্ষ করছি, সুনির্দিষ্ট একটা পক্ষকেই সামনে থাকতে এবং আন্দোলনের সব ক্রেডিট নিতে। তবে আমরা এখনো চাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকুক এবং ঐক্য টিকে থাকুক। তবে সম্প্রতি নবগঠিত এক রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।’
তিনি বলেন, ছাত্রপ্রতিনিধি বলতে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বোঝায় না। প্রথম দিকে তারা অহংকারী হয়ে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু দেশের মানুষ সেটা মেনে নেয়নি। এরা নিজেরাই তো নিজেদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। এই ঐক্যের যারা বিরোধিতা করবে তাদের দেশের মানুষ প্রয়োজনবোধ করবে না।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, ‘শুধু বিএনপির কারণে ঐক্য ধরে রাখতে বিলম্ব পেতে হচ্ছে। তবে বর্তমান অনেক সংকট নিরসন করে এনসিপি এগিয়ে যাচ্ছে।’
এসব নিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ইমরান সালেহ বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পৃথক মতাদর্শ থাকবে আলাদা কর্মসূচি থাকবে, তারা সে অনুযায়ী কাজ করবে এটা স্বাভাবিক। একটি দেশে সবাই এক বিষয়ে একমত হবে, এমন তো কিছু নেই। তবে রাজনৈতিক সংকট আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়। সেই আলোচনায় এক নাও হতে পারে, এর অর্থ এই নয়, আমাদের মধ্যে ঐক্যমত নেই। আমরা মনে করছি, জুলাই-আগস্টের সেই ঐক্য আছে এবং সেটি একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ঐক্যের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে দেশের মানুষ মুক্ত হতে না হতেই এক বছরের মধ্যেই ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন সময় শক্ত কথা বলেছেন, এটা ঠিক হয়নি। ছাত্রদের ক্রেডিট তাদের দিতে হবে এটার চাপ প্রয়োগের কারণেও রাজনৈতিক সংকট নিয়মিত তৈরি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে রাজনৈতিক বড় দলগুলোর অবদান একবারেই ভুলে গেলেও চলবে না। আন্দোলনে তারাও আহত, নিহত হয়েছেন। সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাদেরও। তবে ছাত্রদের আমরা সবাই সাপোর্ট দিয়েছি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, জুলাই বিপ্লব কারো একার অবদান নয়। এটি ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে দেশের সব শ্রেণির মানুষের। এ দেশে যারাই আবার ফ্যাসিবাদী আচরণ করতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধেই আবারও জাতীয় ঐক্য তৈরি হবে। দেশে যদি কোনো বড় ধরনের কোনো সংকটে দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ঐক্যের ডাক আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের সবাই কিন্তু রাজনীতি করতে চায় এবং সবকিছু তারা নিজেরাই করতে চায়। তারা মূলত দেশের জন্য নয়, জনগণের জন্য নয়, শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এসব অপর্কম করে, সেটা আমরা অতীতে দেখেছি। তবে জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী কয়েক মাস অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য ছিল। বর্তমানে সেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে এ অনৈক্য দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়।’

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন