- নতুন অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য
- যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার ১৫ শতাংশে আনার আলোচনা চলছে
- ভারতের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞায় প্রভাব পড়বে না
- পাম তেলের দাম লিটারে কমলো ১৯ টাকা
- প্রয়োজনে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর নতুন অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা খাতে মোট ৬৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার আরও কমাতে কূটনৈতিক আলোচনার উদ্যোগ, ভারতের নতুন অশুল্ক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলা, জ্বালানি সংকট ও কাস্টম জটিলতা দূরীকরণ, অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় এবং পেঁয়াজ আমদানির পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই লক্ষ্যমাত্রার ঘোষণা দেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৬৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর নতুন অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছে সরকার। সে অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন (৬ হাজার ৩৫০ কোটি) মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পণ্য খাতে ৫৫ বিলিয়ন (৫ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার এবং সেবা খাতে ৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন (৮৫০ কোটি) ডলার রপ্তানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামগ্রিক রপ্তানি আয় হয়েছিল প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলার। নতুন অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং সেবা খাতে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদায়ী অর্থবছরের অর্জন ও ঘাটতি
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ শতাংশ। অপরদিকে সেবা খাতে ৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য সচিব বলেন, গত অর্থবছরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমরা মোটের ওপর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছি। এবার সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরও বড় লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করব।
খাতভিত্তিক রপ্তানি পরিকল্পনা
নতুন অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতের দুই উপখাতে আলাদা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ওভেন পোশাকে ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার এবং নিট পোশাকে ১২ দশমিক ০১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য স্থির হয়েছে।
এ ছাড়াও পাট ও পাটপণ্যে প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ ধরে ৯০০ মিলিয়ন ডলার, কৃষিপণ্যে ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হ্রাসে আলোচনার অগ্রগতি
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে ধাপে ধাপে কমিয়ে বর্তমানে ২০ শতাংশে নামিয়েছে। সরকার এখন এ হার আরও কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনার জন্য আলোচনা চলমান।
তিনি বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারসহ নানা বিষয় আলোচনায় তুলেছি। তিন হাজার ৮০০ পণ্যের আমদানি শুল্ক শূন্য থেকে ১ শতাংশের মধ্যে, যা আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে উপস্থাপন করেছি। জ্বালানি পণ্য আমদানিও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সহায়ক হবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ক্ষুণœ হয়Ñ এমন কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। আমরা সতর্ক ছিলাম এবং সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ব্যবসায়ীদের মতামত ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হ্রাস আমাদের জন্য ইতিবাচক অর্জন। সঠিক পরিকল্পনা ও সমস্যাগুলো সমাধান হলে লক্ষ্য ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
তিনি গ্যাস সংকট, কাস্টম জটিলতা, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং সেগুলো দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানান।
ভারতের নতুন পাটপণ্য নিষেধাজ্ঞা
ভারত সম্প্রতি চারটি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের চার ধরনের পাটপণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে মুম্বাইয়ের নভসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে এসব পণ্য আমদানির সুযোগ থাকায় বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
এর আগে ১৭ মে ভারত স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা, ফল ও কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানিতে বিধিনিষেধ দেয়। ৯ এপ্রিল কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধাও বাতিল করে তারা। বাংলাদেশও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।
পাম তেলের দাম কমলো, পেঁয়াজ আমদানির চিন্তা
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় দেশে পাম তেলের দাম লিটারে ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। আগে এই দাম ছিল ১৬৯ টাকা। তবে সয়াবিন তেলের দাম অপরিবর্তিত থেকে লিটারে ১৮৯ টাকা রয়েছে। বাণিজ্যসচিব বলেন, কাঁচামালের দাম না কমায় সয়াবিন তেলের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
এদিকে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে যে দেশ থেকে সস্তায় পাওয়া যাবে সেখান থেকে আমদানি করার পরিকল্পনা করছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, চাহিদা জোগানের সমন্বয় করে প্রয়োজন হলে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের আশাবাদ
ব্যবসাবাণিজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রভাব প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, দেশের অবস্থা এতটা অস্থিতিশীল নয় যে, রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন