ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) শুধু শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত ফোরাম নয়। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অনন্য এক প্রতিষ্ঠানের নাম। মহান মুক্তিসংগ্রাম থেকে শুরু করে জাতীয় সংকটসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে ডাকসু রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। যার অনুপ্রেরণা পাথেয় হয়ে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীরা আশার আলো দেখে। তবে তার ফল খুব বেশি আশানুরূপ ছিল না। এর প্রায় ৬ বছর পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন।
এই নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষাঙ্গনে যেমন উচ্ছ্বাস রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংশয়ও। তারপরও শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখছেন নতুন সম্ভাবনার। এদিকে এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব পড়বে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণে। একই সঙ্গে এটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রিহার্সাল হিসেবেও দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব জাকসু, রাকসু, চাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও দেখা যেতে পারে।
ইতিমধ্যে ডাকসু নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঠে নেমে তাদের সমর্থিত প্যানেল প্রার্থীদের পক্ষে চালাচ্ছে প্রচার-প্রচারণা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন শুধু ক্যাম্পাস রাজনীতির সীমায় আটকে নেই।
বরং তা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটারদের মানসিকতা ও রাজনৈতিক সমীকরণেও বড় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ভোট বিএনপির জন্য নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেও মনে করেন তারা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এই নির্বাচনের তাৎপর্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে দেওয়া সেই তরুণরাই রাজপথে থেকে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রূপরেখায়ও প্রভাব বিস্তার করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচন শুধু ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জাতীয় রাজনীতির সমীকরণে ডাকসু: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডাকসুর নানাবিধ প্রভাব রয়েছে বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ডাকসু ভোটের মাঠে ছাত্রদলের দিকে ঝুঁকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। একই সাথে এই সম্ভাবনা আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির জন্য বড় সুবিধা দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদের ভোট বিএনপির দিকে আসার সম্ভাবনা প্রবল। স্বাধীনতার আদর্শসহ বিএনপির মধ্যম পন্থার রাজনীতি এই সুবিধা এনে দেবে। যার মাধ্যমে নির্বাচনি সমীকরণ পাল্টে যাবে। অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে বিএনপি। আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টিও তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে চাপের মুখে পড়বে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন শুধু ছাত্র সংসদে ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং জাতীয় নির্বাচনের আগে জনমত যাচাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরিবর্তনের প্রথম ইঙ্গিত মিলবে ঢাবির ডাকসু নির্বাচনে। তবে ছাত্রশিবির যদি ডাকসুতে শক্ত অবস্থান নিতে পারে, তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ও মনোবল বাড়বে বহুগুণে। যার প্রভাব পড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে। জামায়াতে ইসলামীর ভোট ও জোটের জন্য এটি ইতিবাচক বলেই বিবেচিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম এ বিষয়ে বলেন, ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনেও বেশ প্রভাব ফেলবে। তবে সেটি কতটা তা পরিষ্কারভাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ যদি নির্বাচিত হয়, তাহলে তাদের দর-কষাকষির জায়গা বাড়বে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এক ধরনের নেগোসিয়েশন, দেন-দরবার, জোট-ঐক্যজোট হয়। ফলে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেউ জিতলে তারা বিভিন্ন আলোচনায় বাড়তি সুবিধা পাবে। ছাত্রশিবিরের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ছাত্রশিবির জিতলে সমাজে জামায়াতে ইসলামীর একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর জনসমর্থন কেমন সৃষ্টি হয়েছে, না শুধুই সামাজিক মাধ্যমে হাইপ বা প্রোপাগান্ডা, তার একটি অ্যাসিড টেস্ট হতে চলছে ডাকসু নির্বাচন। তবে বিএনপির ওপর এ নির্বাচন কম প্রভাব পড়বে জানিয়ে খোরশেদ আলম বলেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই মেজরিটি পেতে পারে, যা অনেকেই মনে করেন। ফলে নির্বাচনে ডাকসুর ফলাফল তেমন প্রভাব ফেলবে না। ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ডাকসু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকেই। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে এ নির্বাচনে। যারা নির্বাচিত হবেন, তারা জাতীয় নির্বাচনে প্রচারণায় ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি কোনো দলের পক্ষে প্রচারণা চালান, সেটি বড় প্রভাব রাখবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, ছাত্রদের এই নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখবে না। এটি শিক্ষার্থীদের নির্বাচন। এখানে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা হবে। যদিও ডাকসু বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, কিন্তু তার অর্থ এই নয়, জাতীয় পর্যায়ে ভোটাররা প্রভাবিত হবে।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাবিতে পড়তে আসেন। তাদের বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজনের এই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আছে। কিন্তু এটি জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না। জাতীয় নির্বাচনের সাথে এখানকার নির্বাচনের দাবি-দাওয়া ও স্বার্থের কোনো মিল নেই। এখানে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয় আছে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ একাধিক বিষয় জড়িত। ফলে এখানের নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না।
ডাকসুতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সমর্থকদের কৌশল:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ছাত্রলীগকেও। এবারের ডাকসু নির্বাচনে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কোনো প্রার্থী নেই। ছাত্রলীগ বাদে ডাকসু নির্বাচনের মাঠে লড়ছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ, গণঅধিকার পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রীসহ বামপন্থি সংগঠনগুলোর সমর্থিত প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ লড়াইয়ের মাঠে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের অ্যাক্টিভিস্ট ও সমর্থকদের অনেকে অনলাইনে শিবির ঠেকানোর ডাক দিয়েছে। ছাত্রদলকে ‘সেকেন্ড বেস্ট’ হিসেবে ভোট দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।
তবে সার্বিকভাবে এবারের ডাকসু নির্বাচন ব্যতিক্রমভাবেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ হলোÑ আজ সারা দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এই নির্বাচন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন