বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এক বিশেষ নাম। এটি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির অন্যতম ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনÑ প্রতিটি ঐতিহাসিক সংগ্রামে ডাকসু রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই একে অনেকে দেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ হিসেবেও অভিহিত করেন।
ডাকসুর গঠন
১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই হলভিত্তিক ছাত্র সংসদ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথমে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাঁচে মুসলিম হল ইউনিয়ন গঠিত হয় আহমদ ফজলুর রহমানের হাত ধরে। পরে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের উদ্যোগে গঠিত হয় ঢাকা হল ও জগন্নাথ হল ইউনিয়ন। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ। প্রত্যেক হল থেকে তিনজন ছাত্র, একজন শিক্ষক এবং উপাচার্যের মনোনীত আরেকজন শিক্ষক নিয়ে গঠিত হতো এই সংসদ। সভাপতি হতেন একজন শিক্ষক।
১৯৪৪-৪৫ সালে নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হলে ছাত্ররা নিজেরাই সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত করার সুযোগ পান। অবশেষে ১৯৫৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। এর ইংরেজি আদ্যক্ষরের ভিত্তিতে ‘ডাকসু’ নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ডাকসু নির্বাচনের পরিসংখ্যান
১৯২৩ সালে গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৩৭ বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। ভিপি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) এবং জিএস হন মাহবুবুর জামান। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ১৯ বার নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে মাত্র ৭ বার হয়েছে। ১৯৯০-এর পর নির্বাচন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯১, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৬, ১৯৯৮ ও ২০০৫ সালে একাধিকবার তপশিল ঘোষণা হলেও বিভিন্ন কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তা ছাত্রলীগের কারচুপি ও প্রভাবের অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রায় ছয় বছর পর আজ মঙ্গলবার আবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। এবার ২৮টি পদের বিপরীতে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে ৫০৯টি।
ডাকসুর নেতৃত্ব ও অবদান
ডাকসুর ইতিহাস শুধু নির্বাচন বা পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর মূল গৌরব নিহিত রয়েছে নেতৃত্বের ভূমিকায়।
ভাষা আন্দোলন (১৯৫২):
রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ডাকসু নেতারাই নেতৃত্ব দেন।
ছয় দফা ও গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৬ ও ১৯৬৯):
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থনে ছাত্রনেতারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন, যা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১):
ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি ও সূচনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন (১৯৯০): একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ডাকসু নেতারা ছিলেন সামনের সারিতে।
ডাকসুর প্রথমদিকের নেতাদের মধ্যে আবদুল আজিজ (প্রথম ভিপি) ও মিজানুর রহমান (প্রথম জিএস) কর্মজীবনেও ছিলেন সফল। পরবর্তীতে আতাউর রহমান খান (মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী), আহমেদুল কবির (‘সংবাদ’ সম্পাদক), গোলাম আযম, এস এ বারি, জুলমাত আলী খানসহ অনেকেই জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন