এক সময় গ্রামের খাল-বিলে দেখা মিলত শত রকমের দেশীয় প্রজাতির মাছ। পুঁটি, টেংরা, চিংড়ি, বাইন, কই, শিং, মাগুর, গজারÑ এসব ছিল প্রান্তিক মানুষের এক সময়ের খাদ্য নিরাপত্তা আর পুষ্টির প্রধান উৎস। এখন সেই খাল-বিলে চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন নামের মারণজালের ব্যবহারে ধ্বংসের মুখে দেশীয় মাছের প্রজাতি। অতিক্ষুদ্র ফাঁসবিশিষ্ট এসব জাল কাঠামো পরিবর্তন করে বিভিন্ন নাম ধারণ করে। যে নামেই ব্যবহৃত হোক এ জাল দেশীয় মাছের সর্বনাশ করেছে। সহজে বেশি মাছ ধরা যায়, ফলে এসব জালের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। যে কারণে নিকট ভবিষ্যতে দেশি প্রজাতির মাছ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বিলের ছোট ছোট খাল ও জলাশয়ে এসব জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরছেন স্থানীয়রা। বলা যায়, মারণজাল ব্যবহার করে দেশি মাছ ধরার এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে উপকূলীয় এলাকায়। সব ধরনের দেশীয় প্রজাতির মাছ এ জালের ফাঁদে ধরা পড়ছে। বর্ষা মৌসুমে মাছের প্রজনন হওয়ায় এ জালের উৎপাতও বেশি দেখা যায়। এতে ক্রমেই মাছশূন্য হয়ে পড়ছে নদ-নদী ও খাল-বিল। স্থানীয় জেলেরা জানান, চায়না দুয়ারি জালে সব ধরনের মাছ ছেঁকে ওঠে, সহজেই মাছ ধরা যায় এবং দাম কম হওয়ায় সবাই এ দুয়ারি ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া অনেক শৌখিন মৌসুমি মাছ শিকারিরাও মাছ ধরতে নেমেছেন। ফলে যারা পুরোনো কৌশলে মাছ ধরতেন, তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে এসব জাল কিনছেন।
বুচনা জাল এবং চায়না দুয়ারি জাল বিলে পাতা হয়। এ জাল মাছের পোনা ধ্বংসকারী। যা পানির নিচে ছোট মাছ তো ধরেই, ডিম ও পোনাও রক্ষা পায় না। আটন জাল পাতা হয় পুরো খাল বা বিল ঘিরেÑ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। ফলে শুধু মাছ নয়, জলজ পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, এমনকি মাছের খাবারও চলে যায় জালে।
‘একটা খালে ২-৩ বার আটন টানলেই সেখানে আর মাছ থাকে না। যে মাছগুলো একসময় গ্রামের শিশু-কিশোররা বাঁশের ছিপে ধরে আনন্দ পেত, সেগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে সস্তা লাভের ফাঁদে’Ñ এমনটাই জানালেন মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নের মম্বিপাড়া গ্রামের জেলে আবুল কালাম।
ওয়ার্ল্ডফিসের গবেষণা সহকারী বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘দেশের গ্রামীণ জলাশয়, খাল, বিল, পুকুর ও দিঘিতে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে এসব মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এ ফাঁস এতটাই ছোট যে, মাছের পোনা থেকে পোকামাকড় পর্যন্ত আটকে যায়। এসব জালের কারণে অনেক বিলে এখন আর আগের মতো মাছ দেখা যায় না। খাদ্যশৃঙ্খলেও ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে। তাই প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জব্দ ও ধ্বংস করতে হবে এ জাল।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের ৩০টির বেশি দেশীয় মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এর অন্যতম কারণ হলো অবৈধ জালের নির্বিচারে ব্যবহার। ‘এই জাল নিষিদ্ধ হলেও খাল-বিল বা নদীর শাখায় গোপনে ব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসনের নজর যেখানে বড় নদী, সেখানে গ্রামের খালগুলো অবহেলিত’Ñ এমন মন্তব্য মাছ ব্যবসায়ী আনিচুর রহমানের।
২০১৫ সালের মৎস্য সংরক্ষণ বিধিমালায় ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের কম ফাঁসযুক্ত জাল নিষিদ্ধ। বুচনার ফাঁস তার চেয়েও ১০ গুণ ছোট। তবু বাজারে প্রকাশ্যে খোলামেলাভাবে এসব জাল বিক্রি হয়। বিভিন্ন হাটে পাওয় যায় এসব জালের নতুন নতুন সংস্করণ। যা ভিন্ন ভিন্ন নামে গ্রাম্য জেলের হাতে চলে আসে। মহিপুর বাজারের এক বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চাহিদা আছে, তাই আমরা বিক্রি করি’। আলীপুর গ্রামের জেলে আমির হোসেন বলেন, ‘বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, তাই কিনি। ভালো মাছও পাওয়া যায়। ক্ষতি হয় জানি, সবাই কিনে তাই আমিও কিনি’।
খালবিলের মাছ শুধু পুষ্টি নয়, গ্রামীণ জীবনের অংশ। মাছ ধরা, রান্না করা, গ্রামীণ মেলা কিংবা উৎসবে দেশীয় মাছের উপস্থিতি একসময় ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন পাতে নেই সেই স্বাদ, উৎসবেও নেই সেই ঐতিহ্য।
চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন জালের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে কার্যকর অভিযান পরিচালনা, খাল-বিল ও ছোট নদী এলাকায় নিয়মিত তদারকি, বিকল্প পেশা বা প্রযুক্তি দিতে হবে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের। এ ছাড়া পোনা সংরক্ষণের জন্য খালভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা ও স্থানীয় মসজিদ-মাদ্রাসা বা স্কুলকে অন্তর্ভুক্ত করে জোর প্রচার চালানোর পরামর্শ সচেতন মহলের।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, আমাদের মৎস্য অধিদপ্তরের সুরক্ষা আইন-১৫০ এর ধারায় জালটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই জাল আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইতোপূর্বেই আমরা উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ৪৮০টি জাল পুড়ে ধ্বংস করেছি। এই জালের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নিয়ে যেতে আমরা মৎস্য অধিদপ্তর কাজ করছি।
চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন জালের প্রতিটি ফাঁসে হারিয়ে যাচ্ছে একটি প্রজাতি, একটি গ্রামীণ ঐতিহ্য, আর একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের আশ্বাস। খাল-বিলের দেশীয় মাছ বাঁচাতে হলে এখনই দরকার পদক্ষেপ। না হলে অচিরেই এসব মাছের নাম কেবল বইয়ের পাতায় থেকে যাবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন