বাংলাদেশে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে নতুন বই তুলে দেওয়ার ঐতিহ্য এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক কার্যক্রম নয়, বরং দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক গৌরবোজ্জ্বল উদ্যোগ। শিশুদের নতুন বই পাওয়ার আনন্দ, অভিভাবকদের মুখে স্বস্তি, আর রাষ্ট্রের অঙ্গীকার সবমিলে জাতি তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই পাঠ্যবই বিতরণে কোনো ধরনের বিলম্ব বা মানের ঘাটতি পুরো প্রক্রিয়াটির সাফল্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
রোববার রূপালী বাংলাদেশে প্রকাশিত ‘কম দরের কাজে মান নিয়ে শঙ্কা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক স্তরে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে জটিলতা এবং শিক্ষাবর্ষের শুরুতে মানসম্পন্ন বই বিতরণ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠে এসছে তা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপা নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নতুন শিক্ষাবর্ষে মানসম্পন্ন বই বিতরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে। পুনঃদরপত্রে সরকারের ব্যয় প্রায় ৩১০ কোটি টাকা কমে আসা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। জনগণের করের টাকায় ব্যয় সংকোচন সরকারের দায়িত্বও বটে। কিন্তু খরচ কমানো যদি বইয়ের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে দেশের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য দরদাতারা প্রাক্কলিত দরের তুলনায় সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর দিয়েছেন। কোনো কোনো লটে ফর্মা প্রতি দর পড়েছে মাত্র ১ টাকা ৭৩ পয়সা থেকে ১ টাকা ৯০ পয়সা পর্যন্ত। অথচ বাজারদর অনুযায়ী শুধু কাগজ কেনার খরচই এত বেশি যে, ওই দরে সম্পূর্ণ বই ছাপিয়ে সরবরাহ করা কার্যত অসম্ভব। এতে যুক্ত হয়েছে কালি, কাভার, বাইন্ডিং, পরিবহন, ট্যাক্স, ব্যাংক সুদসহ অসংখ্য খাত। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এত কম দরে মানসম্মত বই পাওয়া আদৌ সম্ভব কি না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন , অনেক প্রেস লোকসান গুনেও কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ কাজ হাতে এলে পরবর্তী সময়ে কাগজের স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন, কালি ও বাইন্ডিংয়ে মানহ্রাস কিংবা সময়সীমার অজুহাতে ছাড় পাওয়ার সুযোগ থেকে তারা লাভবান হতে পারে। বড় প্রেসগুলো হয়তো লোকসান মেনে মান বজায় রেখে বই সরবরাহ করতে পারবে, কিন্তু ছোট ও মাঝারি প্রেসগুলোর ক্ষেত্রে তা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এতে নির্দিষ্ট সময়ে বই না পাওয়া কিংবা নি¤œমানের বই হাতে পাওয়ার ঝুঁকি প্রবল হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে সময়ের চাপও একটি বড় সমস্যা। নভেম্বরের শেষ দিকে বই ছাপার কাজ শুরু হলে জানুয়ারির প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই দেওয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অমর একুশে বইমেলার প্রস্তুতি, প্রেস ও বাইন্ডারদের ব্যস্ততা এবং আগামী বছরে জাতীয় নির্বাচন, সব মিলিয়ে বাস্তব চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। ফলে সময়মতো বই সরবরাহ করা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন সবার মনে।
তবে এ সংকট অমোঘ নয়। যেসব লটে অস্বাভাবিকভাবে কম দর পড়েছে, সেগুলো অবশ্যই পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। দরদাতাদের ডেকে তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা নেওয়া জরুরি, কীভাবে তারা এত কম দরে কাজ সম্পন্ন করবে। প্রয়োজনে কিছু লটে নতুন করে দর আহ্বান কিংবা শর্ত সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি ছাপার প্রতিটি ধাপ, কাগজ সরবরাহ থেকে শুরু করে মুদ্রণ, বাইন্ডিং ও পরিবহন পর্যন্ত, কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। কোনোভাবেই মানের সঙ্গে আপস করা চলবে না।
আমরা আশা করব, খরচ বাঁচানো এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর হাতে মানসম্পন্ন বই তুলে দেওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। কারণ বই শুধু পড়াশোনার উপকরণ নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের মূল ভিত্তি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন