আবারও ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বড় ধরনের ড্রোন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে রাশিয়া রাতভর প্রায় ৫০০টি ড্রোন ও ৪০টি মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেও হামলা অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় চারজন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়েছেন। এসব তথ্য জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সিএনএনের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম বৃহৎ আক্রমণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, হামলায় কিঞ্জাল নামের শক্তিশালী ক্রুজ মিসাইলও ব্যবহার করেছে রাশিয়া। এই ঘৃণ্য হামলাটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষ হওয়ার সময়েই চালানো হয়েছে উল্লেখ করে জেলেনস্কি বলেন, এভাবেই রাশিয়া তাদের আসল অবস্থান প্রকাশ করছে। এদিকে কিয়েভে বোমাবর্ষণের মধ্যেই পোল্যান্ড তার আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে রুশ ড্রোন আক্রমণের পর থেকেই সতর্ক অবস্থায় রয়েছে পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনী। পোলিশ সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, ‘এই পদক্ষেপগুলো প্রতিরোধমূলক প্রকৃতির, যা আকাশসীমা ও নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে।
ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রুশ ড্রোন ও মিসাইল হামলার কারণে শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে বিমান হামলার সতর্কতা জারি ছিল। রোববার সকালে রাজধানী কিয়েভের আকাশে বিস্ফোরণের ধোঁয়া ভাসতে দেখা যায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দপ্তরের প্রধান আন্দ্রি ইয়েরমাক টেলিগ্রামে এক পোস্টে জানান, আবাসিক ভবন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা হয়েছে। তিনি রুশ আক্রমণকে ‘নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দেন।
কিয়েভে নিহতদের মধ্যে একজন ১২ বছর বয়সি এক কন্যাশিশুও রয়েছে বলে জানিয়েছেন শহরের সামরিক প্রশাসনের প্রধান টিমুর তকাচেঙ্কো। কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিচকো টেলিগ্রামে এক পোস্টে বলেন, ধ্বংসাবশেষের আঘাতে শহরের একটি পাঁচতলা ভবনের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া একটি ব্যক্তিগত বাড়ি ও একটি কিন্ডারগার্টেনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, এ হামলায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরও অন্তত ২৭ জন। কিয়েভ ছাড়াও জাপোরিঝিয়া ও অন্যান্য শহরে রাতভর হামলা চালিয়েছে মস্কো। জাপোরিঝিয়ায়ও ১৬ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। আহতদের মধ্যে তিন শিশুও রয়েছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ এই হামলায় শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ হামলার বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি রাশিয়া। রাশিয়ার এই হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেন, ‘রাশিয়া কেবল ইউক্রেনেই থেমে থাকবে না। আর এ কারণেই ন্যাটো জোটভুক্ত ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতা যাচাই করছে রাশিয়া। ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না পুতিন। আরও কয়েকটি ফ্রন্ট সে চালু করবে।’ পশ্চিম ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর রোববার ভোরে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে সতর্ক অবস্থান নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পোলিশ সশস্ত্র বাহিনী। তারা বলছে, এটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। ১০ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের আকাশসীমায় ন্যাটো ও পোলিশ বিমান তিনটি রুশ ড্রোন ধ্বংস করার পর থেকে এমন পদক্ষেপ নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, ডেনমার্কেরও অভিযোগ, তাদের বিমানবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ড্রোন উড়িয়েছে রাশিয়া। যদিও এ ঘটনায় দায় স্বীকার করেনি মস্কো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ এনেছে এস্তোনিয়াও। এ ধরনের অনুপ্রবেশের প্রতিক্রিয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তকে শক্তিশালী করতে একটি বিশেষ অভিযান চালু করেছে ন্যাটো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিজেদের আকাশসীমায় রুশ বিমান ভূপাতিত করা উচিত। তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন এবং প্রথমবারের মতো বলছেন, ‘মস্কোর কাছ থেকে ইউক্রেনের সব জমি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।’
এদিকে, গতকাল শনিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বক্তব্যে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, রাশিয়ার লক্ষ্য ইইউ বা ন্যাটো সদস্য দেশে আক্রমণ নয়। তবে মস্কোর দিকে যেকোনো ‘আক্রমণের’ বিরুদ্ধে তারা ‘কঠোর প্রতিক্রিয়া’ জানাবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
রাশিয়া আতঙ্কে পোল্যান্ডের আকাশসীমা সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, বাল্টিক সাগরে বেড়েছে ন্যাটোর উপস্থিতি। জানা যায়, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার নতুন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে পোল্যান্ড। রাজধানী ওয়ারশ’র দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় লুবলিন ও রেজশোভ শহরের আকাশসীমা রোববার বন্ধ রাখা হয়। দেশটির সেনাবাহিনী জানায়, ‘অপ্রত্যাশিত সামরিক কার্যক্রম’ মোকাবিলায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই ন্যাটো বাল্টিক সাগরে তাদের মিশন জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে। ডেনমার্ক ও নরওয়েতে সামরিক স্থাপনার কাছে একের পর এক রহস্যজনক ড্রোন দেখা যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ন্যাটোর একটি আকাশ প্রতিরক্ষা যুদ্ধজাহাজসহ গোয়েন্দা, নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহের প্ল্যাটফর্ম মোতায়েন করা হচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, রাশিয়ার হামলার কারণে রোববার স্থানীয় সময় ভোর ৩টার দিকে পুরো দেশে বিমান হামলার সতর্কতা জারি করা হয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় হামলা শুরু করেন এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য তার মার্কিন প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে আসছেন। জেলেনস্কি বলেন, ‘পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে অপেক্ষা করবেন না। তিনি অন্য কোনো দিক খুলে দেবেন। কেউ জানে না সেটা কোথায়।’ ইউক্রেনের রাজধানীতে সর্বশেষ রুশ হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে মিত্র দেশগুলোকে সতর্ক করে তিনি এই মন্তব্য করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন