নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর দৌড়ঝাঁপ বাড়তেই থাকে। কখনো হাইকমিশনে কখনো বা দলীয় কার্যালয়ে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রচলিত ধারায় বাড়ছে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ। সেই ধারাবাহিকতায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের আনাগোনা ও আলাপচারিতা বেড়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করছেন। শুধু সরকারই নয়, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও বেড়েছে বৈঠকের সংখ্যা। সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে বেশি বৈঠক হয়েছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির সাথে। পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কিংবা জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির সাথেও। কূটনৈতিক ওইসব আলোচনার নানা ইস্যুর মধ্যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকছে নানা কৌশলে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতকল্পে আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি প্রতিনিধিরা।
অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিই নয়Ñ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে একটি কূটনৈতিক বৈঠক। এ নিয়ে নানান মহলে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগেও বিদেশি কূটনীতিক ও প্রতিনিধিদলের সদস্যদের আগমনে মুখর হয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সময় আগত বিদেশি কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অহেতুক হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছিল। এবারও নির্বাচনকেন্দ্রিক একই দৃশ্যপট সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভূ-রাজনীতিতে বিশ্ব মোড়লদের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা রাজনৈতিক মহলে বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সরব। সরকারও আমলে নিচ্ছে বিষয়টি। এমন কূটনৈতিক তৎপরতা সামনে জটিল কোনো রাজনৈতিক সংকটের আভাস দিচ্ছে কি না সেদিকে চোখ সবার। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নির্বাচন কমিশনের সাথেও বৈঠক করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মিশনের কূটনীতিকরা। নির্বাচন কমিশনে বৈঠক শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে যাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সহায়তা নিশ্চিত করা যায়। আমরা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে এগোচ্ছি। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে চার মিলিয়ন ইউরোর বেশি সহায়তা প্যাকেজ দিচ্ছি। ইইউ’র এই সহায়তা প্যাকেজের আওতায় নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধি, নাগরিক পর্যবেক্ষণ জোরদারকরণ, অপারেশনাল পরিকল্পনা এবং বিরোধ নিষ্পত্তিসহ নানা ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা হবে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা বৈঠক সেরেছেন ইতিমধ্যে। এতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, সরকার গঠন নিয়ে ভাবনা, জয় পেলে কীভাবে দেশ গড়তে চায়, দেশ ও জনগণ নিয়ে পরিকল্পনা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশিরা। তবে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা সরকারের দপ্তর থেকে বারবার নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও শঙ্কার মেঘ যেন কাটছেই না। গত এক বছরে বাংলাদেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমেরিকা, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং সৌদি আরবসহ ৩০টিরও বেশি দেশের কূটনৈতিকরা বৈঠক করেছেন।
পৃথক পৃথক এসব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।
নির্বাচনের আগে কূটনৈতিক বৈঠকে ঘুরে-ফিরে নির্বাচন ও ভূ-রাজনীতিই মূল কারণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এতকিছুর পরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়েই গেছে। এর বিপরীতে গত এক বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিবাচক উন্নতি ঘটেছে। পাকিস্তান প্রতিনিধি বা কূটনীতিকদের বাংলাদেশে ঘন ঘন আগমন ঘটছে। এমন সংবাদে নড়েচড়ে বসছে ভারত। নানা ইস্যূ তৈরি করে কূটনীতিক পাঠিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারাও।
গত সোমবার দিল্লিতে বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ডিক্যাবের সাথে মতবিনিময়ে সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির কথায় বোঝা যায় সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। অনড় অবস্থান থেকে সরে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবে তাদের সাথে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা যত এগোবে, বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতাও তত বাড়বে। নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা অংশ নেবে কিংবা নির্বাচনের পরে কী হবেÑ এসব নিয়ে ধারণা নিতে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ চলছে। তাই সব পক্ষের সঙ্গেই বসছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। এর বাইরে বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূত ও পলিটিক্যাল কাউন্সিলররা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় বসছেন, যেখানে নির্বাচনের রোডম্যাপ, সংস্কার এবং ক্ষমতায় এলে তাদের দেশ পরিচালনার রূপরেখা কেমন হবেÑ তা নিয়ে কথা হচ্ছে। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে নানা ইস্যুতে আলোচনা করছেন বিদেশি মিশনের কূটনীতিকরা।
বর্তমানে কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে, বিষয়টা ঠিক এমন নয়, অতীতেও নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিকদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের মিল খুঁজে পাচ্ছেন, যা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনিবার্য করে তোলে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটিনেস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সে সময়কার আলোচিত নাম। রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সত্য প্রমাণিত হয় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের তারবার্তা থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বরাবরের মতো এবারও বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা কলোনিয়ান মনোভাব থেকেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। অথচ এটা তাদের দায়িত্ব নয়। আর আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের স্বার্থে সেটা গ্রহণ করেন। উন্নত কোনো দেশে নির্বাচনের আগে এই ধরনের তৎপরতার নজির নেই।
বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কূটনৈতিক বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়। সব দেশই বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। তারা নির্বাচন-পরবর্তী ‘আগামীর বাংলাদেশ’ দেখতে চায়, সেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী কীভাবে করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়। সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বেরিস একিনচির সঙ্গে। সবার মতো তার্কিও নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার এলে সেই সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কূটনীতিকরা মূলত একটি নির্বাচিত সরকার চান। বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। শ্রমবাজার রয়েছে। নির্বাচিত সরকার না হলে কোনো কাজই ঠিকমতো হয় না। নির্বাচিত সরকারের সাথে কাজ করতে মুখিয়ে আছে দেশগুলো।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক হচ্ছে। তবে অতীতের মতো আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত চাপ সৃষ্টি করছেন না, তারা আমাদের মোটিভ বোঝার চেষ্টা করছেন নির্বাচনে আমাদের ভূমিকা কী হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে করণীয় কী হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান তুহিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করেন, তারই ধারাবাহিকতার এনসিপির সাথে বৈঠক করছেন তারা। তার মূলত জানতে চায় আমাদের দল নির্বাচনে কোনো শঙ্কা দেখছে কি না। আমাদের ভূমিকা কী হবে। এসব বিষয়েই আলোচনা হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন