দেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান অস্থিরতা ও দীর্ঘদিনের অনিয়মে জর্জরিত পাঁচটি ইসলামিক শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে নতুন একটি সরকারি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই রেজল্যুশন বা একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ নামে নতুন একটি ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব ইতোমধ্যে অনুমোদনের পথে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রক্রিয়ার একটি বিস্তারিত পথনকশা তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে ধাপে ধাপে একীভূতকরণ সম্পন্ন হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই সরকারি ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে বহুদিন ধরে আর্থিক সংকটে থাকা পাঁচটি বেসরকারি ইসলামিক ব্যাংকের দায়, সম্পদ ও জনবল একত্র করে একটি কাঠামো দাঁড় করানো হবে। রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে স্থাপন করা হবে একটি বিশেষ প্রকল্প কার্যালয়, যেখান থেকে পুরো একীভূত প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে।
মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থসচিব এবং বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি)। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাঁচটি ইসলামিক শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়ে জানতে চাইলে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই বিকল্প ছাড়া সরকারের হাতে আর কোনো পথ ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সরকারকে একীভূতকরণের পথে যেতে হচ্ছে। এখন এর সফলতা কতটুকু হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
চূড়ান্ত অনুমোদনের পথে একীভূত প্রস্তাব
পথনকশা অনুযায়ী, আজ পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই বৈঠকেই অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। পরিষদ অনুমোদন দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করবে এবং পরবর্তীতে ধাপে ধাপে একীভূতকরণ শুরু হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়েছে, সেগুলো হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সপোর্ট ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক।
এই পাঁচটির মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। দুই গোষ্ঠীই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আমানতকারীদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যার বড় অংশ এখন আর উদ্ধার সম্ভব নয়।
একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার ধাপ ও কাঠামো
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ, দায় ও মানবসম্পদ একত্র করে নতুন ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা হবে। এর মূলধনের বড় অংশ অর্থায়ন করবে সরকার, ফলে এটি একটি সরকারি নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হবে। পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব এবং আর্থিক বিশেষজ্ঞরা।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করবে। প্রশাসক হবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বা পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা, যিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বও পালন করবেন। প্রশাসক নিয়োগের পর বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করা হবে।
প্রশাসক দল ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা যৌথভাবে পাঁচ ব্যাংকের আমানত, ঋণ, তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবসম্পদ বিভাগ একীভূত করবেন। পরে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক এসব সম্পদ ও দায়ভার অধিগ্রহণ করবে। একীভূতকরণ শুরু হলে ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোর পুরোনো নাম ও সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে নতুন নাম ব্যবহৃত হবে।
নতুন ব্যাংকের মূলধন কাঠামো
পাঁচ ইসলামিক ব্যাংকে বর্তমানে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা দিবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন ‘ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড’ বা আমানত বিমা তহবিল থেকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা শেয়ার আকারে রূপান্তর করা হবে। বাকি সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ার রূপে রূপান্তরিত করে মূলধন পূরণ করা হবে।
অর্থনৈতিক চিত্র: আমানত, ঋণ ও খেলাপি ঋণের বাস্তবতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মে মাসে পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত নেমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায়। অথচ একই সময়ে তাদের সম্মিলিত ঋণস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকাÑ যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ। ব্যাংকভেদে এই হার ভয়াবহ। ইউনিয়ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ শতাংশ।
ফলে পাঁচ ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকায়। এই ঘাটতি পূরণের কোনো সুনির্দিষ্ট পথ এখনো নির্ধারিত হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার ও বিশেষ সহায়তা
অমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ও তারল্য সংকট মোকাবিলায় পাঁচ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ বিশেষ ধার নিয়েছে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক নিয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৫০ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৬ হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার ২৯৫ কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই ধার নেওয়ার পরও ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের ঘাটতি এবং আমানতকারীদের উত্তোলনের চাপ এখনো অব্যাহত রয়েছে।
ঋণ উদ্ধার ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, একীভূত প্রক্রিয়ার পর খেলাপি ঋণ উদ্ধারের জন্য একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি) গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখনো প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন না হওয়ায় সেই প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ফলে আপাতত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়ায় ঋণ উদ্ধার অব্যাহত রাখবে।
এদিকে একীভূতকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সরকার আট সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে। এই কমিটি একীভূত প্রক্রিয়ার আইনগত দিক, প্রশাসনিক কাঠামো ও সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা বিশ্লেষণ করছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা ও উদ্বেগ
সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুসলিম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এত বড় আর্থিক পুনর্গঠন এই প্রথম হতে যাচ্ছে। তাই একে একধরনের ট্রায়াল বলা যেতে পারে। সরকার এটিকে প্রথম বা দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে নয়, বরং শেষ বিকল্প হিসেবেই নিয়েছে। কারণ, যদি সরকার এই ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করত, তাহলে আর্থিক খাতে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারত, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো হতো না। ফলে সরকারের এই উদ্যোগের পরিণতি কী হয়, তা এখন সময়ই বলে দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, এ ধরনের বৃহৎ রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক ব্যাংক ও শেয়ারহোল্ডার হয়তো আদালতে যেতে পারেন। তাই সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এগোতে হবে। ৩৫ হাজার কোটি টাকার মূলধন দিয়ে দেড় লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ সামাল দেওয়া সম্ভব কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।
তিনি আরও বলেন, এসব ব্যাংকের দায়ি ব্যক্তিদের এখনো কেউ শাস্তি পায়নি। যদি দায়িদের জবাবদিহির আওতায় না আনা হয়, তাহলে একীভূতকরণ শুধুই বাহ্যিক সমাধান হয়ে থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট তৈরি হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা আরও মনে করছেন, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ সর্বাগ্রে সুরক্ষিত না হলে এই একীভূত প্রক্রিয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। অনেক ক্ষুদ্র গ্রাহক তাদের সঞ্চয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
একীভূতকরণের সম্ভাব্য প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক গঠন দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া হতে যাচ্ছে। এটি সফল হলে দীর্ঘদিনের দুর্বল ইসলামিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে। তবে ব্যর্থ হলে এটি নতুন করে সরকারি অর্থের অপচয় ও আমানতকারীদের আস্থা হ্রাসের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাই একীভূতকরণের প্রতিটি ধাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসনিক, প্রযুক্তিগত ও আর্থিক তদারকির জন্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের একটি বিশেষ সেল গঠন করবে। এই সেল নতুন ব্যাংকের নীতি, ক্রেডিট ব্যবস্থাপনা, সাইবার সুরক্ষা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দেখভাল করবে।
সবকিছুর পরও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতের আস্থার সংকট নিরসনে এই একীভূতকরণ একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু কেবল নাম বদলে নতুন ব্যাংক গঠন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, প্রয়োজন কঠোর জবাবদিহি, দায়িদের বিচার এবং আর্থিক নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। না হলে একীভূত পাঁচ ব্যাংকের জায়গায় একক ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংকও অতীতের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি হয়ে উঠতে পারে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন