*** শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও কার্যক্রম চলছে পুরোনো ভবনেই
*** গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া অন্যদের ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত
*** প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকছেন ৫০-৬০ জন রোগী,
*** ১৭ মেডিকেল কর্মকর্তার থাকার কথা থাকলেও আছে ৪ জন
একদিকে চিকিৎসক সংকট, অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনÑ দুইয়ের চাপে রংপুরের পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম প্রায় ভেঙে পড়েছে। প্রত্যাশিত সেবা না পেয়ে রোগীদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন আগে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও কার্যক্রম চলছে পুরোনো ভবনেই। পুরুষ, নারী ও শিশু ওয়ার্ডের পাশাপাশি জরুরি বিভাগ ও প্যাথলজি ইউনিটও চলছে ওই ভবনে। সম্প্রতি নারী ওয়ার্ডের ছাদের পলেস্তারা খসে এক রোগী আহত হন। পরে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নারী ও শিশু ওয়ার্ডকে পুরুষ ওয়ার্ডের অর্ধেক অংশে সরিয়ে নেওয়া হয়। গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া অন্যদের ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত করা হলেও প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ জন রোগী ভর্তি থাকছেন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেককে বারান্দা ও মেঝেতে থাকতে হচ্ছে।
জনবল কাঠামো অনুযায়ী হাসপাতালে ১৭ জন মেডিকেল কর্মকর্তার থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছেন মাত্র ৪ জন। উপায় না পেয়ে একজন এমওডিসিকেও ইনডোরে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আউটডোরে ১১ জন কনসালট্যান্ট থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ৫ জন। গাইনি ও অবস বিভাগের চিকিৎসক প্রেষণে থাকায় পার্শ্ববর্তী কাউনিয়া উপজেলা থেকে সপ্তাহে দুই দিন একজন কনসালট্যান্ট এসে সেবা দেন।
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে আউটডোরে প্রায় ৭০০ রোগী চিকিৎসা নেন। সীমিত চিকিৎসক নিয়ে এত রোগী সামলানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ঘাটতিও চরম আকার ধারণ করেছে। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৯৪ জনের স্থলে আছেন ৫৭ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ২৩ জনের স্থলে আছেন মাত্র ৮ জন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৫ জনের জায়গায় ৩ জন, আয়া ৩ জনের জায়গায় ১ জন এবং ওয়ার্ড বয় ৩ জনের জায়গায় আছেন ১ জন।
বাবুর্চি, সিকিউরিটি গার্ড ও এমএলএসএস শূন্যপদে রয়েছে। জনবল না থাকায় আউটডোরে টিকিট কাউন্টারে নিরুপায় হয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালকের স্ত্রীকে বসানো হয়েছে। জনবল সংকটের কারণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সেবার মান ব্যাহত হচ্ছে। রোগীদের কাছ হতে প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে নানা অভিযোগ।
এ ছাড়া প্যাথলজি বিভাগে সব ধরনের টেস্টের সুযোগ থাকলেও রিএজেন্টের সংকটে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায় প্রায়ই। যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি দেখা দিলে চিঠি চালাচালির কারণে মেরামতেও সময় লাগে। ফলে রোগীদের অনেক সময় বাইরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে টেস্ট করাতে হচ্ছে। ২০১৫ সালে দেওয়া ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে অচল। বর্তমানে পুরোনো মেশিন দিয়েই কাজ চলছে। নতুন মেশিনের বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। সনোলজিস্ট না থাকায় আলট্রাসনোগ্রাম সেবা অনিয়মিতভাবে দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, আগের নারী ও শিশু ওয়ার্ডে তালা ঝুলছে। দেয়ালে সাদা কাগজে লেখা ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’। ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে, কোথাও দেখা দিয়েছে ফাটল। যদিও ওই ভবনের তুলনামূলক ভালো অংশে পুরুষ ওয়ার্ড চালু রাখা হয়েছে এবং সেখানেই পৃথকভাবে রাখা হচ্ছে নারী ও শিশু ওয়ার্ডের রোগীদের। তবে নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় এখনো চলছে জরুরি বিভাগ, প্যাথলজি, ডিউটি রুম, লেবার রুম, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অফিসসহ অন্যান্য কার্যক্রম। ডিউটিরত মিডওয়াইফ কামরুন্নাহার বলেন, রোগীদের নিরাপদে সরালেও আমরা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সেবা দিচ্ছি। প্রতিনিয়ত আতঙ্ক নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
হাসপাতালের একমাত্র আয়া শিখা রানি জানান, তিন শিফটে একা আমার পক্ষে ডিউটি করা সম্ভব নয়। তার পরও রোগীদের ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। আরও আয়া নিয়োগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগী মেঝে ও বারান্দায় রয়েছেন। ওয়ার্ডের ওয়াশরুম, টয়লেট বেশ নোংরা। রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তাররা ভর্তি করতে চাইছেন না। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই অনেককে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে।
উপজেলার তাম্বুলপুরের রফিকুল ইসলাম তার সন্তানকে ডিহাইড্রেশনের কারণে ভর্তি করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা খুব খারাপ। কিছু স্টাফ আন্তরিক নন। রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। বিরক্তি নিয়ে সেবা দেওয়ায় রোগীরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আউটডোরে দেখা গেছে, কাক্সিক্ষত চিকিৎসক না থাকায় অনেকেই চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন। অনেকেই চিকিৎসকের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছেন।
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ তানভীর হাসান রবিন বলেন, সব সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে চিকিৎসক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংকট দূর হলে সেবার মান বাড়বে। এ বিষয়ে অনেকবার চিঠি দিয়েছি। স্টাফদের রোগীদের সঙ্গে ভালো আচরণের বিষয়ে নিয়মিত নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রংপুর সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা বলেন, চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনেক চিকিৎসক পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি করতে চলে যাওয়ায় চিকিৎসকের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে আবার প্রেষণে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে গেছেন। এটাও সংকটের কারণ। প্রেষণ আদেশ বাতিলের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৪৮তম বিসিএসের পর চিকিৎসক সংকট হয়তো অনেকটা নিরসন হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়টি স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। তারা বরাদ্দ সাপেক্ষে কাজ করবে। স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, হাসপাতালটিতে জরুরি ভিত্তিতে নতুন ভবন নির্মাণ ও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হোক।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন