সুদানের আকাশ আজ বারুদের গন্ধে ঘন। দারফুরের মাটিতে ছড়িয়ে থাকা রক্ত শুকায় না, কারণ প্রতিদিন নতুন করে ঝরে পড়ে নিরপরাধ মানুষের জীবনরস। এল ফাশার, যে শহর একসময় ছিল বাণিজ্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুর রাজধানীতে। র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামের আধা-রাষ্ট্রীয় মিলিশিয়া বাহিনী যখন এই শহরটি অবরুদ্ধ করল, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল নির্লিপ্ত দর্শক হয়ে রইল। মানবতার ওপর সংঘটিত এই গণহত্যা কেবল সুদানের নয়; এটি সমগ্র সভ্যতার নৈতিক দেউলিয়া হওয়ার প্রতীক। গত আঠারো মাস ধরে যে ভয়াবহতা সুদানে ঘটছে, তা কোনো আকস্মিক অভ্যুত্থান নয়Ñ এটি এক দীর্ঘ পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলাফল। হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবিরÑ সব জায়গায় রক্তাক্ত বাস্তবতা। এল ফাশারের একটি প্রসূতি হাসপাতালে ৫০০ জন নারী, শিশু ও পরিবারের সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।
বেঁচে ফেরা কয়েকজন সাক্ষী বলেছে, আরএসএফের যোদ্ধারা বেসামরিকদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচারের নামে গুলি চালিয়েছে। যারা পালাতে চেয়েছে, তাদের ধর্ষণ, নির্যাতন বা গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উপগ্রহ চিত্রেও রক্তের দাগ দৃশ্যমান। যুদ্ধ পর্যবেক্ষকরা একে তুলনা করেছেন রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে। কিন্তু পার্থক্য হলোÑ রুয়ান্ডায় বিশ্ব অন্ধ ছিল, আর সুদানে বিশ্ব চোখ খুলে অন্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি, তথ্য ও কূটনীতির যুগেও একটি জাতি যদি এভাবে নিশ্চিহ্ন হতে থাকে, তবে তা মানবসভ্যতার আত্মাহুতির শামিল। সুদানের এই যুদ্ধ কেবল দুই সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, যেখানে উপসাগরীয় অর্থ, পশ্চিমা অস্ত্র ও আফ্রিকান রক্ত এক হয়ে গেছে।
২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতি ওমর আল-বশির পতনের পর সামান্য গণতান্ত্রিক আশার আলো দেখা দিয়েছিল। জনগণ ভেবেছিল, দশকের পর দশক ধরে সামরিক শাসনের কবল থেকে দেশটি মুক্তি পাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ বিপ্লবের ছাই থেকে উঠে আসা নতুন ক্ষমতাকাঠামো আরও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াল। আরএসএফ, যা একসময় জানজাউইদ মিলিশিয়া হিসেবে পরিচিত ছিল, বশিরেরই সৃষ্টিÑ একটি শক্তি যা শুরুতে দারফুরের বিদ্রোহ দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাহিনী পরিণত হয় এক আধা-স্বাধীন সামরিক শক্তিতে, যার পেছনে প্রবল আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জাল ছিল। আরএসএফের নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি ‘হেমেতি’ নামে পরিচিত, আজ আর কেবল একজন কমান্ডার নন; তিনি এক অঘোষিত রাষ্ট্রশক্তি, যার হাতে সোনা, অস্ত্র, অর্থ ও আন্তর্জাতিক সংযোগের সংমিশ্রণ। এই ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমিরাত, যারা নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে, তারাই আজ সুদানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক।
আরএসএফের হাতে অর্থ, অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পৌঁছেছে আমিরাতের নেটওয়ার্ক থেকে। এমনকি আরএসএফের অনেক যোদ্ধা ইয়েমেন যুদ্ধেও আমিরাতের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে লড়েছিল। বিনিময়ে আমিরাত পেয়েছে দারফুরের সোনার খনি ও সম্পদ-সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।
এখানেই শুরু হয় আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের নতুন অধ্যায়Ñযেখানে যুদ্ধ আর কেবল রাজনীতি নয়, বরং ব্যবসা। রক্ত আর সোনা একত্রে গলে যায় মুনাফার কড়াইয়ে। এল ফাশারের প্রতিটি মৃতদেহ, প্রতিটি শরণার্থী, প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরÑএকটি বৃহৎ অর্থনৈতিক হিসাবের অংশ। এই যুদ্ধের পেছনে মানবতার স্থান নেই; আছে শুধু স্বার্থ ও প্রভাবের জটিল অঙ্ক। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা এখানে আরও ভয়াবহ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সÑযারা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে কথার ফুলঝুরি ছড়ায়, তারাই বাস্তবে নীরব দর্শক। কারণ, এই নীরবতা তাদের স্বার্থের সুরক্ষা দেয়। যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা আফ্রিকান কূটনীতিকদের বলেছেন, আমিরাতের সমালোচনা না করতে। একই সময়ে ব্রিটিশ সামরিক সরঞ্জাম আরএসএফের হাতে দেখা গেছে।
মার্কিন প্রশাসনও সংযত অবস্থান নিয়েছে, কারণ তারা উপসাগরীয় মিত্রদের বিরাগভাজন হতে চায় না। এ হলো বাস্তব রাজনীতিÑ যেখানে কূটনীতি পরিণত হয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তববাদের আর্থিক গণিতে। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্রÑ এসব শব্দ এখন ব্যবহৃত হয় কেবল তখনই, যখন তা পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুদানের রক্তক্ষয়ী বাস্তবতা এই দ্বিচারিতার নগ্ন উদাহরণ। কিন্তু এই যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এর মানবিক বিপর্যয়। ১৫০,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত, তিন কোটির বেশি মানুষ জরুরি খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে ভুগছে, আর দেড় কোটিরও বেশি শিশু শিক্ষা হারিয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, এটি এক মৃত সভ্যতার প্রতিধ্বনি।
যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবিক সহায়তা দিতে চেয়েছে, তারা আরএসএফের অবরোধে আটকা পড়েছে। এল ফাশারে এখন এমন এক বাস্তবতা, যেখানে মানুষ পশুখাদ্য খেয়ে বেঁচে আছে। এটি কেবল যুদ্ধ নয়; এটি এক জাতির বিলুপ্তির প্রক্রিয়া। দারফুরের অ-আরব জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরএসএফ যেভাবে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে, তা স্পষ্টতই গণহত্যার সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়াÑ এক কথায় ম্লান। বিবৃতি আসে, নিন্দা আসে, কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিশ্ব আজ এমন এক দ্বৈত নৈতিকতার ফাঁদে পড়েছে, যেখানে ইউক্রেনের জন্য চোখের জল ঝরে, কিন্তু দারফুরের জন্য নেই কোনো অশ্রু। গাজার ধ্বংস নিয়ে বিতর্ক হয় জাতিসংঘে, কিন্তু এল ফাশারের গণহত্যা থেকে বিশ্ব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মানবতা আজ নীরব, কারণ রক্তের রং এখন আর কেবল ন্যায় বা অন্যায়ের প্রতীক নয়Ñ এটি নির্ধারিত হয় ভূরাজনৈতিক মানচিত্র দিয়ে।
সুদানের এই যুদ্ধ কেবল বর্তমানের নয়; এটি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ২০০৩ সালে দারফুরে জানজাউইদ বাহিনীর হাতে ৩ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল, আর আজ সেই ইতিহাস নতুন রূপে ফিরে এসেছে। একমাত্র পার্থক্যÑ আজ আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে, তথ্য আছে, কিন্তু বিবেক নেই। আধুনিক সভ্যতা এখন সেই একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে একসময় ইউরোপের শক্তিগুলো উপনিবেশ স্থাপন করেছিলÑ মানবিকতার মুখোশ পরে সম্পদের জন্য হত্যা করেছিল লাখ লাখ মানুষকে। এই অবস্থার নেপথ্যে যে বৃহত্তর চিত্রটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি আরও ভয়াবহ। আফ্রিকা এখন পরিণত হয়েছে নতুন শীতল যুদ্ধের মঞ্চে। একদিকে পশ্চিমা শক্তি, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনÑউভয়ের লক্ষ্যই প্রভাব বিস্তার। সুদানের মতো কৌশলগত রাষ্ট্রগুলো তাই পরিণত হচ্ছে পরীক্ষাগার। আফ্রিকার ভূখ-ে এখন চলমান প্রতিটি সংঘাত, প্রতিটি সামরিক অভিযান আসলে বৃহত্তর ভূরাজনীতির প্রতিফলন। সুদান এই জালে আটকা পড়েছে। একদিকে আমিরাত ও সৌদি আরবের অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষা, অন্যদিকে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের ছায়াÑ এই দুইয়ের সংঘাতে দেশটি আজ রাষ্ট্র হিসেবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
পশ্চিমা বিশ্ব এই দ্বন্দ্বে নির্লিপ্ত, কারণ তাদের জন্য এটি ‘আঞ্চলিক বিষয়’। কিন্তু এই আঞ্চলিক বিষয়ই পরিণত হচ্ছে বৈশ্বিক বিপর্যয়েÑ যেখানে শরণার্থী প্রবাহ, সন্ত্রাসবাদের উত্থান, এবং মানব পাচারের নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। সুদানের এই রক্তক্ষয় বিশ্ব রাজনীতির এক ভয়াবহ শিক্ষাও বহন করেÑ কোনো জাতির গণহত্যা তখনই সম্ভব হয়, যখন বিশ্ব তা দেখতে অস্বীকার করে। এবং আজ পশ্চিমা দুনিয়া সেই অস্বীকারের নৈতিক দায় বহন করছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই মানবাধিকারের বৈশ্বিক রক্ষক হতো, তবে আরএসএফের পৃষ্ঠপোষক আমিরাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিত। যুক্তরাজ্য যদি সত্যিই গণতন্ত্রের ধারক হতো, তবে সুদানে ব্রিটিশ অস্ত্রের উপস্থিতি নিয়ে তদন্ত করত। কিন্তু তারা কেউই তা করছে নাÑ কারণ নৈতিকতা এখন বাণিজ্যিক হিসাবের দাস। এই নীরবতা কেবল অপরাধ নয়, এটি সহযোগিতা। প্রতিটি বিলম্বিত বিবৃতি, প্রতিটি অজুহাত, প্রতিটি ‘দুঃখপ্রকাশ’ হলো আরেকটি গুলির সমান। পশ্চিমা কূটনীতির এই ঠান্ডা রক্তাক্ত বাস্তবতায় সুদানের মানুষদের আর কোনো প্রত্যাশা নেই। তারা এখন জানেÑ তাদের রক্ত পৃথিবীর কাছে তুচ্ছ।
তবুও ইতিহাস নীরব থাকে না। যে সভ্যতা অন্যায়ের মুখে চুপ থাকে, সে সভ্যতা শেষ পর্যন্ত নিজেই ধ্বংস হয়। সুদানের রক্তের হিসাব একদিন মানবতার কোর্টে তোলা হবে, আর তখন পশ্চিমা উদাসীনতা ও উপসাগরীয় লোভের মিলিত মুখোশ খুলে যাবে। আজ এল ফাশারের মাটিতে প্রতিটি মিনিট মানে একেকটি প্রাণ। প্রতিটি মৃতদেহ যেন একেকটি প্রশ্নÑ ‘তোমরা কোথায় ছিলে, যখন মানবতা মরছিল?’ এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, কারণ সভ্যতা এখন ব্যস্ত নিজের অজুহাত খুঁজতে। সুদানের রক্তে ভেজা বাতাসে একটি বাক্য ভেসে বেড়ায়Ñ ‘নীরবতাই সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।’ পশ্চিমা বিশ্ব এই অস্ত্রের ব্যবহার জানে, আর তাই তারা রক্ত দেখে কিন্তু কাঁদে না; মৃত্যু দেখে কিন্তু চুপ থাকে। এল ফাশারের ধ্বংসাবশেষে কেবল মানুষ নয়, মানবতার আত্মাও চাপা পড়েছে। পশ্চিমা নীতিকৌশলের শীতল অঙ্কে, উপসাগরীয় সাম্রাজ্যবাদের লোভে, এবং আফ্রিকার মাটিতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নামহীন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আজ পৃথিবীকে স্বীকার করতেই হয়Ñ
আমরা এক রক্তাক্ত সভ্যতার উত্তরাধিকারী, যেখানে মানবতা নয়, স্বার্থই সর্বশক্তিমান।
মো. শামীম মিয়া
শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, গাইবান্ধা

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন