বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাস পর পর এই ঋতুর পালাবদল চলে। প্রতিটি ঋতু তার নিজস্ব রূপ, লাবণ্যে ও বৈশিষ্ট্যে আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়। হেমন্তকালও তার ব্যতিক্রম নয়। কার্তিক ও অগ্রহায়ণÑ এই দুই মাস হেমন্তকাল। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ঋতুকন্যা হেমন্ত যেন সুখ-দুঃখের বেদনার মতো। শুরুতে অভাব-অনটন, আর শেষটা সুখ-শান্তিতে বেঁচে থাকার অনাবিল আনন্দের উৎস।
এ সময় গ্রাম-বাংলার সবুজ মাঠগুলো ঢেকে যায় হলুদ চাদরে। মাঠে মাঠে সোনালি ধানের প্রাচুর্য। সবুজ ও সোনারঙের মাঠগুলোতে মুক্তার কারুকাজ। সকালবেলায় সূর্যের কাঁচা আলোয় মুক্তার দানাগুলো নানা বর্ণের রং ছড়ায়। সোনালি বর্ণের আমন ধানের ম-ম গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হিমেল হাওয়ায় নয়নাভিরাম পাকা ধানের শীষগুলো থেকে সৃষ্টি হয় সুমধুর সুর। মাঠে মাঠে চলে ফসল কাটার ধুম।
ধান কাটতে ভোরবেলায় কৃষকরা কাস্তে
হাতে ছুটে যায় মাঠে। গোধূলিলগ্নে ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে আবার ফিরে আসে। নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসবে মেতে ওঠে কৃষান-কৃষানিরা। পরিবারের নারী সদস্যরা গভীর রাত পর্যন্ত ঢেঁকিতে ধান ভানতে থাকে। তারা একে অপরের কাঁধে হাত রেখে ছন্দে ছন্দে ঢেঁকিতে পাড় দেয়। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শিকড় থেকেই নবান্ন উৎসবের প্রচলন। নবান্ন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ধান ও পিঠার উৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’ বা ‘নব অন্ন’। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব।
সাধারণত বাংলা অগ্রহায়ণ মাসে অর্থাৎ হেমন্তকালে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপনের প্রথা রয়েছে। নতুন ধান থেকে প্রাপ্ত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে ঘরে ঘরে চলে নবান্নের উৎসব। নতুন চালের ফিরনি, পায়েস, ক্ষীর রান্না করে তা আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। তৈরি করা হয় নানা রকম পিঠা-পুলি ও মুড়ি-মুড়কি। গ্রাম-গঞ্জে নবান্নে মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করা, মসজিদে মিলাদ ও শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজ আজও প্রচলিত। নবান্ন উৎসব এখন আর শুধু গ্রামে নয়, শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের সূচনা হয়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ প্রতি বছর ১ অগ্রহায়ণ তারিখে এ উৎসবের আয়োজন করে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন শোবিজ এন্টারটেইনমেন্ট রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে বিগত ১২ বছর ধরে তিন দিনব্যাপী নবান্ন উৎসব ও পিঠা মেলার আয়োজন করে আসছে। ঐতিহ্যগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা এবং ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চে এ উৎসব তিন দিনব্যাপী চলে।
উৎসবে নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি, নবান্ন কথন, ঢাক-ঢোলের বাদন ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করা হয়। শহরের কোথাও কোথাও পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। পিঠার স্টলগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রসিদ্ধ পিঠা-পুলি বিক্রি করা হয়। নবান্ন উৎসব প্রাচীন বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি। এই উৎসবকে ঘিরে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তাতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে। অবশেষে শীতের আগমনী বার্তা দিয়ে হেমন্ত বিদায় নেয়। স্বকীয় মর্যাদায় আবহমান গ্রাম-বাংলায় হেমন্ত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই ঋতুকন্যা হেমন্ত অনেকের কাছেই প্রিয় ঋতু হিসেবে বিবেচিত হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন