ক্ষুধার্তদের খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে হত্যা করার ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে গাজায়। সর্বশেষ পানি সরবরাহকেন্দ্রে হামলা করে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৬০ জন চিকিৎসাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েল। গাজার সরকারি গণমাধ্যম অফিস জানিয়েছে, পরিকল্পিত ‘তৃষ্ণার্ত যুদ্ধ’-এর অংশ হিসেবে পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর হামলায় ৭০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ১১২টি মিঠা পানি সরবরাহ কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে ৭২০টি পানির কূপ ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলোর পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে। সাড়ে ১২ লাখের বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানির সুবিধাবঞ্চিত। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৫৮ হাজার ছাড়িয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় শতাধিকবার বিমান হামলা চালিয়েছে দখলদার বাহিনী। রোববার ১১২টি পানি সরবরাহকেন্দ্রে হামলা করে সাত শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে সেনারা। তাদের হামলায় ৭২০টি পানির কূপ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অনাহারের পর এবার পানির তৃষ্ণায় হত্যাযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে ইসরায়েল।
আলজাজিরা জানায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে নেতানিয়াহুর বাহিনী। তারা গাজাবাসীকে হত্যায় নতুন নতুন কৌশল নিচ্ছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা নিশ্চিত করছি, এই বর্ণবাদী নীতি জেনেভা কনভেনশনের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।’ অফিসটি জানায়, ইসরায়েল গাজায় প্রতি মাসে ১ কোটি ২০ লাখ লিটার জ্বালানি প্রবেশে বাধা দিয়েছে।
এই পরিমাণ জ্বালানি আটকে থাকায় অচল হয়ে পড়ে পানি সরবরাহ কূপ, পয়োনিষ্কাশন কেন্দ্র, আবর্জনা সংগ্রহকারী যানবাহন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা। পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে গেছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে রোগের আরও বিস্তার ঘটেছে। গত ৯ মার্চ ইসরায়েল গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর এল-বালাহতে পানি বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ লাইনটি কেটে দেয়। ফলে পানি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পানিসংকট আরও গভীর হয়। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব। কাতারের রাজধানী দোহায় যুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
আলোচনায় ৬০ দিনের একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে কথা হচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ১০ জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি ও ১৮ বন্দির মরদেহ ফেরতের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। পরে স্থায়ী শান্তিচুক্তি নিয়ে কথা হবে। ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি আশা করেন, এই সপ্তাহে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধবিরতির আলোচনা হবে। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিভ উইটকফও এ ব্যাপারে আশাবাদ দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের উপনেতা মুহাম্মদ আল-হিন্দি বলেছেন, ‘বন্দিদের বিষয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগে ইসরায়েল মূল শর্তগুলো মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আমরা একটি কাঠামো চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছি। এতে তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যথাÑ আগ্রাসন বন্ধ করা, গাজা থেকে প্রত্যাহার ও নিরাপদ ত্রাণ বিতরণ।’ এর আগে তার দেওয়া ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আটকে যায়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য মতে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মৃত্যু বেড়ে কমপক্ষে ৫৮ হাজার ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
এ পর্যন্ত আহত হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫২০ জন। রোববার নিহতদের মধ্যে গাজার বিশিষ্ট চিকিৎসক আহমেদ কান্দিলও রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল পরিচালিত তথাকথিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণকেন্দ্রগুলোর কাছে প্রতিদিন ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যা করছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) জানিয়েছে, গত ছয় সপ্তাহে কমপক্ষে ৮৭৫ জনকে হত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
মানবাধিকার অফিস বলছে, নিহতদের বেশির ভাগই গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন সাইটের আশেপাশের এলাকায় নিহত হয়েছেন। ২০১ জন অন্যান্য ত্রাণকেন্দ্রের কাছে প্রাণ হারান। এদিকে গত ২১ মাসে শত শত বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে হাজার হাজার মানুষ। ধ্বংসস্তূপ থেকে তোলা হয় অন্তত এক হাজার মরদেহ। গত ১৮ মার্চ ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার পর থেকে অন্তত ৭ হাজার ৪৫০ জন নিহত হয়েছেন। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ প্রথম যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ১৭০ জনকে হত্যা করা হয়। এ সময়ের মধ্যে ২ হাজার ২০০ মরদেহ ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে তোলা হয়।
১৮ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত নিহত হন ৪৬ হাজার ৯১৩ ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজায় ‘মানবিক শহর’ নির্মাণের আড়ালে রয়েছে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা, বললেন সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট। জানান, ইহুদি হলোকাস্টের মতোই ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন প্রচেষ্টার অংশ এসব ক্যাম্প।
ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ‘বাস্তব পদক্ষেপ’ ঘোষণা করতে বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশ জরুরি সম্মেলনে বসছে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায়। কূটনীতিকরা ‘মিডল ইস্ট আই’-কে এ খবর জানিয়েছেন। মঙ্গলবার ১৫ জুলাই শুরু হয়েছে দুই দিনের এ সম্মেলন।
আপনার মতামত লিখুন :