মাত্র ছয় মাসের মাথায় বাস্তবতা বদলে গেছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্কে দ-িত করেছেন ট্রাম্প, যা আরও বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তিও অনিশ্চিত, যা দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি করেছে। ভারতের অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বিশ^জিৎ ধর বলেন, ‘গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে পৌঁছেছে।’ ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে ভারত বরাবরই চাপের বিষয়।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের উষ্ণ সম্পর্ক হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনা ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতের ওপর আরোপিত বর্ধিত শুল্ক। গত ৪ আগস্ট নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের বিপুল তেল আমদানি রুশ যুদ্ধযন্ত্রে অর্থায়ন করছে এবং এর জন্য দেশটিকে ২৫ শতাংশের চেয়েও অনেক বেশি শুল্ক গুনতে হবে। যুদ্ধের আগে ভারতের তেলের মাত্র ০.২ শতাংশ সরবরাহ করত রাশিয়া। এখন সেই হার বেড়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূলত এ পরিবর্তনের ওপরেই ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। যদিও, এ তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভারত নিজের জাতীয় স্বার্থ ও জ্বালানি নিরাপত্তার কারণ দেখাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই একটি ‘মিনি ট্রেড ডিল’ নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে এতে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের এক নির্বাহী আদেশ অনুসারে, আজ ৭ আগস্ট থেকে ভারতের রপ্তানির ওপর নতুন ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। তবে রাশিয়ার তেল কেনা ইস্যুতে অতিরিক্ত শুল্ক কত হবে তার পরিমাণ এখনো জানানো হয়নি। ট্রাম্প আগেও অভিযোগ করেছিলেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ১৯০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এতে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি ও নরেন্দ্র মোদি একসঙ্গে টেক্সাস থেকে গুজরাট পর্যন্ত স্টেডিয়াম ভরা সমর্থকদের সামনে দুদেশের বন্ধুত্ব উদযাপন করেছিলেন। ভারত তখন ন্যাটো মিত্রদের মতো সামরিক ও প্রযুক্তি সুবিধা পেয়েছিল। চীনের উত্থান ঠেকানোয় উভয়ের মধ্যে কৌশলগত ঐক্যও গড়ে উঠেছিল। ২০২৪ সালের ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের এক জরিপে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ ভারতীয় মনে করতেন ট্রাম্পের ফিরে আসা ভারতের জন্য ভালো। কিন্তু হোয়াইট হাউসে মোদির গত ফেব্রুয়ারির সফরকালে ট্রাম্পের আচরণে ভারতীয় কূটনীতিকরা ‘অবাক’ হন বলেই একটি সাংবাদিক সূত্র জানিয়েছে। ভারতের ব্যাংক অব বারোদা জানিয়েছে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতের ২০২৬ সালের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে ০.২ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, যদিও এরপরও তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে।
বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে গহনা ও টেক্সটাইল শিল্প। তবে ওষুধ ও ইলেকট্রনিকস খাতে বিদ্যমান শুল্কছাড় বহাল থাকছে, যা ভারতের জন্য কিছুটা স্বস্তির।
এ অবস্থায় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত ৪ আগস্ট বলেন, ‘আমরা জটিল ও অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে বাস করছি। আমরা এমন একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা চাই, যা ন্যায্য এবং প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু দেশের কর্তৃত্বাধীন নয়। দিল্লিতে আগামী ২৫ আগস্ট থেকে দুই দেশের মধ্যে ষষ্ঠ দফা বাণিজ্য আলোচনা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও সেখানে যাবেন বলে জানা গেছে।
পাঁচ দফা বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় বাণিজ্য চুক্তির স্বপ্ন দেখছিল নয়াদিল্লি। শুল্ক কমানোর ইঙ্গিত, ছাড়ের প্রতিশ্রুতি সবই ছিল হাতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভুল হিসাব, ভুল সংকেত আর পারস্পরিক অবিশ্বাসে ভেঙে গেল বিশ্বের বৃহত্তম ও পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির এই বহুল প্রত্যাশিত চুক্তি। এ চুক্তি নিয়ে ভারত এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল, তারা গণমাধ্যমকে পর্যন্ত ইঙ্গিত দিয়েছিল, শুল্ক ১৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ হতে পারে। খবর রয়টার্স।
জ্বালানি তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উত্তেজনা বাড়লেও, পোশাক খাতে উৎপাদন অব্যাহত আছে দেশটির। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ২৫ শতাংশ উচ্চ শুল্ক হারের কারণে অনেকটাই অস্বস্তিতে আছে ভারতীয় পোশাকশিল্প। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ শতাংশ শুল্কহারকে স্বাগত জানিয়েছেন পাকিস্তানের তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তান লাভবান হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উৎপাদন খরচের দিকে নজর দিতে হবে পাকিস্তান সরকারকে। আলোচনার মাধ্যমে ৫০টির বেশি দেশের ওপর আরোপিত শুল্কহার কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ছাড়া প্রায় সব দেশের শুল্ক কমানোর বিষয়ে একমত হয় ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের শুল্কহার ৩৫ থেকে কমিয়ে করা হয় ২০ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর শুল্কহার কমায় অস্বস্তিতে আছে ভারতের পোশাক শিল্প। এমন অবস্থায় রাশিয়ান তেল ক্রয় নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে নয়াদিল্লির। জরিমানা হিসেবে দেশটির ওপর শুল্কহার আরও বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের বাজারটি ধরার চেষ্টা করছে ভারত। তবে নতুন শুল্ক ঘোষণায় এখন বাজার হারাতে বসেছে ভারত। চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের পরই মার্কিন পোশাক খাতের বাজারের অন্যতম দেশ ভারত। উচ্চ শুল্কের পরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান পোশাক তৈরি অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামী কয়েকটি ব্র্যান্ডের ক্রয়াদেশ পূরণে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তবে ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতায় কতটুকু টিকে থাকতে পারবে তা নিয়ে এরইমধ্যে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।এদিকে, ১৯ শতাংশ শুল্কে অনেকটাই স্বস্তিতে পাকিস্তান। দেশটির তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্কিন শুল্ক ২৯ থেকে কমে ১৯ শতাংশ পাকিস্তানের জন্য বিশাল অর্জন। গেল বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে পাকিস্তান।
হোয়াইট হাউস, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয় এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।